দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট নতুন কিছু নয়। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় গত প্রায় দুই মাস ধরে লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রেও চরম ব্যাঘাত ঘটছে। একদিকে প্রচণ্ড গরম, অন্যদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতির বিঘ্ন ঘটছে। সার্বিক এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি নিরসনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের মধ্যে যথেষ্ট গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রয়েছে বলে পর্যবেক্ষরা মনে করছেন। একদিকে গ্যাস সঙ্কট, অন্যদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ ‘বাণিজ্যিক’ সংযোগের নামে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তার কাছে জনদুর্ভোগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বহুমুখী লোকসান ঠেকাতে বিদ্যুৎ বিভাগ যখন ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন তিতাস নতুন নতুন ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংযোগ অব্যাহত রেখেছে। শিল্পপতিরা এসব সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তিতাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করেছেন।
গ্যাস-বিদ্যুৎ এমন অপরিহার্য পণ্য, যার ওপর কৃষি, শিল্পকারখানার উৎপাদন ও পণ্যমূল্য নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এই দুই পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর সাথে রয়েছে জ্বালানি তেলের সঙ্কট ও দাম বৃদ্ধি। এক ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করেছে। গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিরও চিন্তাভাবনা করছে। এক জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে। সরকার কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া অবলম্বন করেও সঙ্কট মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, গাফিলতি ও দুর্নীতি মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে। এসব কর্তৃপক্ষের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারি সরকারের সদিচ্ছাকে থোড়াই কেয়ার করে নিজেদের আখের গোচাচ্ছে। যেখানে গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সেখানে কম গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ দিয়ে সঙ্কটকে তীব্র করে তুলছে। জ্বালানি সঙ্কট কাটাতে সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও তা পুনরায় চালু করার চিন্তা করছে। অন্যদিকে গ্যাস সঙ্কটের দোহাই দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের মতো চিন্তাও করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, সরকার কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া হিসেবে গত ১১ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়া এই অর্থ ব্যয়ের কারণে সরকারকে ভর্তুকি দেয়ার পাশাপাশি বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হচ্ছে। এই অর্থ জোগাড় করতে হচ্ছে, গ্রাহকদের পকেট কেটে। এমন অনিয়ম বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে, তার খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির খেসারত কেন জনগণকে দিতে হবে? কৃষি, শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যাহত, ব্যয় বৃদ্ধি ও এর ফলে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে কেন জনগণ পিষ্ট হবে?
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বরাবরই আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সাথে সাথে দেশে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ কমলে দাম কমানোর নজির খুব কম দেখা যায়। এই দামবৃদ্ধির দায় জনগণকেই নিতে হয়। সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দাম বাড়িয়ে দায়িত্ব শেষ করে। জনগণের দুর্ভোগের চিন্তা করে না। অথচ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বিরাজমান তা নিরসন করা গেলে দফায় দফায় দামবৃদ্ধিসহ লোকসান-ভর্তুকি কিছুই দিতে হতো না। জনভোগান্তিও এমন চরমে উঠত না। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হলেও মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়ে না। অবৈধ সংযোগ অব্যাহতভাবেই চলছে। গ্যাস, বিদ্যুতের সঙ্কটকালে এই রাস টেনে ধরতে পারলে সঙ্কট অনেকাংশে দূর কার সম্ভব, এ বিষয়টি আমলেই নেয়া হচ্ছে না। অনিয়ম জিইয়ে রেখে সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্টে ফেলা হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের যে সঙ্কট চলছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের উচিৎ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রোধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। সবধরনের অবৈধ ও কমগুরুত্বপূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। দুর্নীতিবাজদের কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাহত ও জনগণ দুর্ভোগের শিকার হবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন