বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের দেয়া তথ্যমতে, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ২০ শতাংশ কমে গেছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ক্রয়াদেশ হিসাব করে তারা এ তথ্য দিয়েছেন। মূলত আমদানিকারক দেশগুলোর উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়ায় রপ্তানি বন্ধ হওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সরাসরি রপ্তানির চাইতে রাশিয়ায় তৃতীয় দেশ থেকে বেশি পোশাক রপ্তানি হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। উল্লেখ্য, বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর এর ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে এবং ৪০ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
সেখানকার দেশগুলোর এ অর্থনৈতিক অস্থিরতায় মানুষ পোশাক নয়, শুধু জরুরি দৈনন্দিন সামগ্রী ক্রয়ের জন্যই অর্থ খরচ করছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্ডার বাতিল করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির এমন সিদ্ধান্তে বড়সড় লোকসানের শঙ্কায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ব্যাবসায়ীরা। ফের একটি অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়ায় তৈরি পোশাকের বাজার প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের। যদিও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় মাত্র ১.৫ শতাংশ। তাই গার্মেন্ট মালিকদের জন্য রাশিয়ার বাজার এক নতুন সম্ভাবনাময়। কারণ, বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় যে রপ্তানি হয় তার ৯৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। তাই এই বাজারে বাংলাদেশের প্রভাব বিস্তার করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতির কারণে সেটিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা জারি ও আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেয়ায় অর্থ লেনদেনে ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে বাংলাদেশি ব্যাবসায়ীদের। কারো কারো পেমেন্ট আটকে পড়েছে, কেউ কেউ ডেলিভারি দেয়ার আগ মুহূর্তে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে বা পিছিয়ে দিয়েছে। এদেশের পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কাঁচামাল সংকট, এক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। ৮০ ভাগ ফেব্রিক আসে চীন থেকে। এছাড়াও বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশ। সুতরাং অর্ডার আসা শুরু করলে সে অনুযায়ী কাঁচামালের ঋণপত্র খোলা হয়, পরবর্তীতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ডার বাতিল বা পিছিয়ে দেয়ার কারণে বিশাল অংকের আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়তে হচ্ছে পোশাক ব্যাবসায়ীদের। সাথে কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিরূপ সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করায় দেশটির সঙ্গে পণ্য আদানপ্রদান জটিল হয়ে পড়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক যে জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হয়েছ, দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি তেল এবং তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজির দাম এক লাফে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকার এর আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে শিল্পকলকারখানাসহ সারাদেশ বিদ্যুৎ সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে। কারণ বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা অনুযায়ী ১৫০০ মেগাওয়াটের ঘাটতি থাকছে সরবরাহে।
ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন (ইউপিজিডিসি) কোম্পানির এক কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজির আমদানি পর্যাপ্ত না থাকায়, গ্যাসভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকলেও এই কেন্দ্রগুলোতে এখন অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত যোগান না দিতে পারায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রচুর লোডশেডিং হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে সেখানে। আর যারা বিদ্যুতের বিকল্প শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের ৫১% আসে গ্যাস থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে আমদানিকৃত এ তরল গ্যাস যোগ করে সে চাহিদা পূরণ করা হয়।
সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা ডলারের সংকটে ভুগছে বিশ্ব। দেশের বাজারেও ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ায় আমদানিকৃত কাঁচামালেরও অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে কাঁচামাল আমদানিকারক প্রতিঠানগুলোকে। বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ। কিন্তু সেই তুলনায় পর্যাপ্ত অর্ডার এবং দাম পাচ্ছেন না তারা। কারণ, কিছুকিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান যুদ্ধের সুবিধা নিচ্ছে ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে। এছাড়া, কাঁচামাল সঙ্কটে সময়মত পণ্য সরবরাহও করতে পারছেন না অনেক ব্যাবসায়ী। কিছু কিছু মার্কিন অর্থনীতিবিদ চলমান জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে ট্রানজিট খরচ কমিয়ে আমদানিকারক দেশগুলোকে পার্শ্ববর্তীদেশগুলি থেকে আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে, যা আমাদের দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আরও হুমকিসরূপ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র তথ্যমতে, কোভিড প্রাদুর্ভাবের পর বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্বের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, এ যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে না পড়লে পোশাক খাত এতদিনে আরো বহু দূর এগিয়ে যেত। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)’র তথ্যমতে, ৪০ লাখ কর্মী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত, যেখানে ৫৮ শতাংশই মহিলা কর্মী। অতএব, কোনো কারণে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা পড়ে গেলে, পোশাক শিল্প খাতের পাশাপাশি অর্থনীতিও বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, ইএমবিএ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন