শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

খরায় জমি ফেটে চৌচির কৃষক দুশ্চিন্তায়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

অনাবৃষ্টির কারণে কক্সবাজার, ঝিনাইদহ ও খুলনার বিভিন্ন এলাকায় আমন চাষের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির পানির অভাবে জমিতে রোপিত আমন ধানের চারা মারা পড়ছে। প্রচণ্ড তাপদাহ ও উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত খবর :
খুলনা ব্যুরো জানায়, প্রকৃতির এ বৈরি আচরণে রোপা আমন চাষের ভরা মৌসুমে খুলনার কৃষকেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। কৃষিবিভাগের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র এক চতুর্থাংশ জমিতে এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে। অন্যদিকে, সেচের মূল জ্বালানি ডিজেল এবং সারসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ এনে দিয়েছে। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে দুর্মূল্যের এ বাজারে কীভাবে আগামী দিনগুলোতে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবেন তা নিয়ে শঙ্কিত কৃষককূল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এ বছর খুলনায় ৯৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ২০ ভাদ্র পর্যন্ত মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা সম্ভব আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি হলে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার হেক্টর জমি আবাদ করা সম্ভব হবে। অর্ধেক জমিই অনাবাদি রয়ে যাবে।
মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টির অভাবে অনেক স্থানেই সময়মত বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। উচ্চমূল্যের ডিজেল চালিত পাম্প ব্যবহার করে জমিতে সেচ ও ট্রাক্টর লাঙ্গল চালাতে গিয়ে কৃষকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার বর্ষা মৌসুমে অর্ধেকেরও কম বৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সালের জুনের ৩৮৮ দশমিক ৮৯ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৫০৬ মিলিমিটার ও আগস্টে ২১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এ বছরের জুনে ৯৪ দশমিক ৩৬ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৯১ দশমিক ২৭ মিলিমিটার এবং ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ১৬১ দশমিক ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি কৃষিতে পড়ছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আইলা ও ইয়াস এর প্রভাবে খুলনার অনেক জমিতেই নদনদীর পানি বাঁধ ভেঙ্গে লবন পানি প্রবেশ করে। যার রেশ এখনো রয়ে গেছে।
কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের জুলাই-আগষ্ট মাসের প্রতিবেদনের বরাদ দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার প্রকৌশলী দিপংকর বালা জানান, খুলনা জেলার অধিকাংশ নদ-নদী, খাল, গভীর ও অগভীর নলকূপের পানি লবণাক্ততার কারণে আমন আবাদের জন্য নিরাপদ নয়। কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলায় নদীর পানি আমন চাষের উপযোগি নয়। এসব এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বেশি। অন্যদিকে, বাকি সাত উপজেলার রূপসা, আঠারোবেকি, ভৈরব, আত্রাই, চিত্রা, শোলমারি, ভদ্রা, বাগমারা, কাজিবাছা, নারায়ণখালি, ঝপঝপিয়া, গ্যাংরাইল, নলুয়া, পশুর, চুনকুড়ি, ঢাকি, শিবসা, মোংলা, খুদে, লাউডোব, চরানদী, ময়ূর, তলার খাল ও বুড়ি ডাবর খালের পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব উপজেলায় উল্লিখিত নদী-খালে ভাটার সময় লবণাক্ততা কমে যায়। ফলে রূপসা উপজেলার তিলক, শিয়ালী, শ্রীফলতলা, দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর, কোলা বাজার, তেরখাদা উপজেলার মধুপুর, শাচিয়াদাহ, আজগড়া., ছাগলাদাহ, ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলেতলা, ডুমুরিয়া উপজেলার রঘুনাথপুর, শোভনা, গুটুদিয়া, বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালি, গংগারামপুর, দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা, বানিশান্তা, লাউডোব ও পানখালি এলাকার আমন ক্ষেতে নদীর নিরাপদ পানি দেওয়া সম্ভব।
জাকের উল্লাহ চকোরী, কক্সবাজার থেকে জানান, অনাবৃষ্টির কারণে পেকুয়ায় আমন চাষের আবাদ নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। ফলে কৃষকরা জমিতে সম্পূরক সেচের মাধ্যমে আমন ধানের চারা রোপণ করেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, বৃষ্টি না থাকায় এসব চারা রোদে শুকিয়ে মারা পড়ছে। ধানের চারাগুলো এখন ফসলি বিলে হলদে রঙ ধারণ করেছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় কৃত্রিম উপায়ে সেচ দিয়ে জমিতে ফসল ফলানো হয়েছে। অতিরিক্ত তাপদাহের কারণে এসব ফসলেও লালচে-মরিচা রঙ ধারণ করেছে। ফসলগুলোতে মড়ক ও ছত্রাকের মতো জটিল রোগ সংক্রামিত হচ্ছে।
উপজেলার টইটং ইউনিয়নের জালিয়ারচাং, বড়বিল, টেইট্যাখালি বিল, কাচারীঘোনা, নিত্যান্ত ঘোনাসহ অনেক স্থানের ফসলি জমিতে লবণাক্ততা গ্রাস করেছে। সমুদ্রের নোনা পানি নিম্নাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। এতে ৫ থেকে ৬টি ফসলি বিলে আমন ধানের চারা মারা পড়ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টইটংয়ের নিত্যান্ত ঘোনায় বিলে মারা পড়ছে আমন ধানের চারা। একই ইউনিয়নের কাচারীঘোনায়ও জমির সদ্য রোপণ করা আমন চারায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ৩নং ওয়ার্ডের টেইট্যাখালি বিলেও বিশাল অংশে ধানের চারা হলদে হয়ে গেছে। ওই বিল এখন ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। জালিয়ারচাং বড় বিলেরও একই অবস্থা। টইটং ইউপি ভবনের পূর্ব পাশে বড়পাড়া বিলে ধানের চারা মারা পড়ছে।
চাষি নুরুল হক জানান, প্রাকৃতিক সমস্যার কারণে এ বছর জমি থেকে ফসল তোলা প্রায় অনিশ্চিত। পাওয়ার টিলা বাবদ প্রতি কানিতে আড়াই হাজার টাকা। আগামসহ প্রায় ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। কী করব বুঝছি না।
যোগাযোগ করা হলে টইটংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোকাদ্দেস মোহাম্মদ রাসেল বলেন, আসলে বিষয়টি প্রাকৃতিক। এ মুহূর্তে সম্পূরক সেচের বিকল্প আমরা দেখছি না। জোয়ার যাতে ফসলি জমিতে প্রবেশ না করতে পারে সে ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা।
এদিকে পেকুয়ার ৭ ইউনিয়নে আমনের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উঁচু স্থানের অনেক জমি এখনো অনাবাদি থেকে গেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় এসব জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সদরের জালিয়াখালী, বকসু চৌকিদারপাড়া, বটতলীয়া পাড়াসহ দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের অনেক জমিতে এখনো ফসল ফলানো যায়নি। মগনামা, উজানটিয়া ইউনিয়নেও একই অবস্থা।
পেকুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তপন কুমার রায় বলেন, যেসব জায়গায় লবণাক্ততা বেড়ে গেছে সেখানে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এর সমাধান আসবে না। বৃষ্টি হতে হবে। আমরা সম্পূরক সেচের পরামর্শ দিচ্ছি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, রাবার ড্যাম সচল করা হয়েছে। মিষ্টি পানির উৎসগুলোতে যাতে নোনা পানি প্রবেশ না করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলা সংবাদদাতা জানান, আষাঢ় গেলো বৃষ্টিহীনতায়। চলে গেছে শ্রাবণও। বৃষ্টির দেখা মেলেনি ভাদ্র মাসের অর্ধেকেও। তীব্র খরা আর ভ্যাপসা গরমে মানুষের ত্রাহি দশা। তপ্ত রোদে ফেটে চৌচির হচ্ছে আমনের ক্ষেত। বৃষ্টির দেখা মেলেনি বর্ষা ঋতুর আড়াই মাসেও। মাঠের পর মাঠ জুড়ে চলছে সেচযন্ত্র। তারপরও কৃষকের স্বস্তি নেই। সেচ দেওয়া পানিও জমিতে বেশিক্ষণ থাকছে না। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। গত শুক্রবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নগরবাথান এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে নিচু বা বিল এলাকার জমিতেও পানি নেই। পানির অভাবে উচু জমির ধান ক্ষেত ফেটে চৌচির। ধান গাছের গোড়ায় পানি না থাকায় পোকা মকড়ের উপদ্রুপ বেড়ে যাচ্ছে। সেচ আর কীটনাশক খরচ মেটাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় আমন আবাদ হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে। আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ চার হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার বাকি জমিতে পাট থাকার কারণে আবাদে দেরি হচ্ছে বলে জানায় জেলা কৃষি বিভাগ। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, পানির অভাবে ফসলের জমিগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এতে অনেক জমির ধান মরে যাচ্ছে। অনেক কৃষক ধান বাঁচাতে জমিতে সেচ দিচ্ছেন। আর প্রতিবার সেচ দিতে বিঘাপ্রতি গুনতে হচ্ছে এক হাজার টাকা। উদয়পুর গ্রামের কৃষক আকাশ বলেন, পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির। ধান লাগানো প্রায় এক মাস হয়ে গেছে, এখনো কোনো উন্নতি নেই। আর জমিতে দেওয়ার জন্য সার তো পাওয়াই যাচ্ছে না। বাজারে সার আনতে গেলে বলছে সার নেই, আবার বেশি টাকা দিলে সার পাওয়া যাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন