নভেম্বরে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তাই আগাম প্রস্তুতি হিসেবে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী খরা-বন্যা প্রভৃতি দুর্যোগে খাদ্যোৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে বলে আশংকা করা হয়েছে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যের আমদানি-রফতানি ও চলাচল বাধাগ্রস্ত করেছে। এতে খাদ্যের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আমদানি-রফতানিও ব্যহত হয়েছে। ফলে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামও বেড়েছে। কৃষিসহ সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ও দামে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খাদ্যের আকাল ও উচ্চদামের পরিপ্রেক্ষিতে আগামীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংস্থা। বন্যা ও খরায় বাংলাদেশে বোরো উৎপাদন কম হয়েছে। বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আমন উৎপাদনও কম হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাকিস্তানে অভূতপূর্ব বন্যায় ফসলাদির ক্ষতিসহ মানবিক বিপর্যয় সীমা অতিক্রম করে গেছে। বলা হয়েছে, এই বন্যায় ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে পাকিস্তান। বন্যা ও খরার শিকার হয়েছে ভারতও। তারও খাদ্যোৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনে খরার কারণে আবাদ-উৎপাদন মার খেয়েছে। এই সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে খাদ্য আমদানি ও বড় রকমের মজুত গড়ে তোলার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কতটা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই উপলদ্ধি করা যায়। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, অনেক আগেই এ নির্দেশনা আসা উচিত ছিল। তাহলে এতদিনে আমদানির আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করে তা কার্যকর করা শুরু হয়ে যেতো। বিলম্বিত নির্দেশনা হলেও আমরা তার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করি, যাতে বিলম্বের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, সরকার এরমধ্যেই রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে খাদ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত যৌক্তিক ও দূরদর্শী হয়েছে। আমদানির সম্ভাব্য উৎসসমূহ এ মুহূর্তে ব্যবহার করা খুবই জরুরি। কোনো কারণে কোনো দেশ রফতানি নাও করতে পারে বা কম করতে পারে। সেজন্য বিকল্প দেশও থাকতে হবে। আমরা জানতে পেরেছি, সরকার রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম কিনছে। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এই গম কেনার অনুমোদন দিয়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ গম দেশে আসবে। ভারত থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন চাল কেনার অনুমোদন এবং চুক্তিও হয়েছে। মিয়ানমার থেকে আতপ চাল আসছে। চাল কেনার চুক্তি হয়েছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের সঙ্গেও। কোনো দেশের অপারগতায় যাতে অসুবিধা বা ঝামেলায় পড়তে না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত কিছু খাদ্য কেনারও নির্দেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। স্মরণ করা যেতে পারে, দেশে বর্তমানে ১৯ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো খাদ্য মজুত আছে। আপাতত এ মজুতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে হতে পারে বৈকি! চাল-আটার দাম হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ওএমএস-এ চাল-আটা বিক্রি শুরু হয়েছে। বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচী চালিয়ে যেতে হবে। এজন্য মজুত চাল-গম থেকে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বেরিয়ে যাবে। খাদ্যকেন্দ্রিক অন্যান্য কর্মসূচীতেও মজুতে টান পড়বে। কাজেই, আমদানি দ্রুততর করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা একটা দেশের জন্য অপরিহার্য। এ কারণে খাদ্যের নিরাপত্তামূলক মজুত থাকার বিকল্প নেই। খাদ্যোৎপাদন আমাদের দেশে যথেষ্টই হয়েছে। তবে সরকারি মহল থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যে দাবি করা হয়, তা সঠিক নয়। যদি তা সঠিক হতো, তবে প্রতি বছর লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হতো না। যা হোক, আশংকিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে দেশ থেকে বা যেখান থেকে খাদ্য পাওয়া যাবে, আমদানি করতে হবে। প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে পারে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে এবার খাদ্যাৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদুপরি পাকিস্তান খাদ্য আমদানি করতে চাইছে ভারত থেকে। এমতাবস্থায়, একটা চাপ ভারতের ওপর তৈরি হতে পারে। সেকারণে ভারত থেকে আমদানির পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আমদানির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। শুধু খাদ্য নয়, অন্যান্য খাদ্যপণ্যও। কিছুটা দূরের থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম থেকে যতটা পারা যায়, আমদানি করতে হবে। এভাবে খাদ্যের নিরাপত্তামূলক মজুত নিশ্চিত করতে হবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র আমদানি করে কোনো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। আমদানি করে খাদ্যের নিরাপত্তামূলক মজুত গড়ে তুলতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন, যা অনেক দেশের পক্ষেই যোগান দেয়া অসম্ভব। তাছাড়া অতীতে দেখা গেছে, কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকার পরও অনেক দেশ খাদ্য আমদানি করতে পারেনি। খাদ্যের অভাব বা ঘাটতিই এর কারণ। খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রয়োজনে কিছু খাদ্য আমদানিও করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথাটি প্রযোজ্য। বাংলাদেশে খাদ্যোৎপাদন মাঝে-মধ্যে ব্যহত বা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও তা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত বীজ, সার, সেচ, আর বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে প্রচুর ধান, গম অন্যান্য খাদ্যশস্য এখানে উৎপাদিত হতে পারে। এসব ব্যাপারে সরকারের আবশ্যিক সহযোগিতা থাকলেই হয়। আমন চাষীরা এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের উচ্চদামে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। মিটিং-মিছিল পর্যন্ত করছে। সরকার কৃষকদের জন্য কিছু সুবিধা ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু সেটা ঠিকমত তাদের কাছে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই কৃষকদের একান্ত সহযোগী হতে হবে সরকারের। কৃষকরা যাতে তাদের ধান ও অন্যান্য ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা, উৎপাদন বাড়িয়েই খাদ্যনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন