শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

সুন্দরবনের কাছে হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন

ডি এম রেজা সোহাগ, খুলনা থেকে : | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সুন্দরবনের কাছাকাছি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির শিংয়েরবাড়ি ঢিবিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খননে উঠে এসেছে নবম হতে দ্বাদশ শতকের অপরুপ স্থাপত্য কাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়া মাটির ফলক, প্রতীমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতত্ত্ব বস্তু। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে ৮ থেকে ৯শ বছর আগে সমৃদ্ধ কোনো জনপদ ছিল। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ছিল তাদের। জীবন মান ছিল বেশ সমৃদ্ধ। তৎকালীন বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব ছিল তাদের উপর। নানা ধরণের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল ওই সময়ে। পরবর্তীতে কোনো প্রাকৃতিক কারণে জনপদটি ধ্বংস হয়ে যায় অথবা অধিবাসীরা অন্যত্র চলে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরও অধিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছে প্রত্নতত্ব অধিদফতর।
এ বছরের মার্চে খনন শুরু হয়। আনুমানিক ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮০ মিটার প্রস্থের ঢিবির দক্ষিণাংশ খননে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেখানে একটি বর্গাকার প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষ পাওয়া গেছে। কক্ষটিকে ঘিরে দেওয়াল দিয়ে বেষ্ঠিত একটি দক্ষিণ পথ রয়েছে। কাঠামোর কোণগুলোতে পাওয়া গেছে কোণিকভাবে প্রসারিত দেওয়াল। ধারণা করা হচ্ছে, আরো বেশি স্থানজুড়ে খনন কার্যক্রম প্রসারিত হলে এর স্বরুপ ও প্রকৃতি অনুমান সম্ভব হবে।
খননকাজে সংশ্লিষ্টরা জানান, উদ্ঘাটিত স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণ পথের বাইরের দেওয়ালের সাথে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় খাদ্যবস্তু কালো রঙের চালের ডিপোজিট পাওয়া গেছে। এই চালের উপর গবেষণা করলে তৎকালীণ সময়ের ধানের প্রজাতি ও প্রতিবেশের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের সময়কাল নবম হতে দ্বাদশ শতক। তবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিস্তারিত খননকাজ পরিচালনা ও প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সম্ভব হলে স্থাপত্যকাঠামোসহ প্রত্নবস্তুর সময়কাল, সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া সম্ভব। খনন কার্যক্রমের প্রথম দিকে স্থাপত্যকাঠামো দেখে সেটি প্রাচীন বৌদ্ধ আমলের মঠ বা এ জাতীয় নিদর্শন বলে ধারণা করা হলেও পর্যায়ক্রমে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু দেখে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ধারণা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মধ্য ও আদি-মধ্যযুগের একগুচ্ছ প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন রয়েছে। ইউনিয়নটির কয়েকটি মৌজায় যেমন, কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর ও কাশিমনগরসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে রয়েছে। সাম্প্রতিক মানব বসতির সম্প্রসারণ ও চাষাবাদের ফলে অনেক এলাকার প্রত্নস্থান ও প্রত্নবস্তু বিলুপ্ত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলের বিভিন্ন জরিপে সংক্ষিপ্তভাবে এখানকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে জেমস ওয়েস্টল্যান্ড, ও মাইলি, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার এর বিভিন্ন জরিপ ও ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারগুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্র’র যশোহর ও খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে কপিলমুনির বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থানের উল্লেখ রয়েছে।
সাতক্ষীরার তালা হতে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী পর্যন্ত (প্রায় ১৪ মাইল) বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ও তৎকালীণ আগ্রা গ্রামে একটি ঢিবির কথা উল্লেখ করেছেন, আ.ক.ম যাকারিয়া তার বাংলাদেশ প্রত্ন সম্পদ বইয়ে।
সতীশ চন্দ্র মিত্র ও আ.ক.ম যাকারিয়া তাদের গ্রন্থে এই এলাকায় পুকুর খননকালে প্রাচীন দু’টি বৌদ্ধ প্রতীমা পাওয়া গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। সম্প্রতি কপিলমুনি এলাকায় প্রাথমিক জরিপকালে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ দল বেশ কয়েকটি প্রত্নস্থান শনাক্ত করেছেন। বিশেষ করে কপিলমুনি বাজারের একটি মন্দিরে বিষ্ণু প্রতীমাটি আনুমানিক ৭ম-৮ম শতাব্দির বলে অনুমান করা হয়। সর্বশেষ খননকাজে প্রত্নবস্তু বিশেষ করে মৃৎপাত্রের শ্রেণিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সময়কালের উপর ভিত্তি করে প্রত্নস্থানগুলো আদি মধ্য যুগের বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, পুরো এলাকার স্থাপনাগুলি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে এলাকাবাসী বিক্ষিপ্তভাবে এখানকার ইট উঠিয়ে আধুনিক স্থাপনাসমূহে এর ব্যবহার শুরু করে। এসব খননে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ইট, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, প্রাণীর হাঁড় উঠে আসে। সর্বশেষ প্রাচীনকালে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় জরিপ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
জরিপ শেষে শনাক্তকৃত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যের ঢিবিগুলোর মধ্যে শিংয়ের বাড়ি রেজাকপুর কপিলমুনি ঢিবিটিকে নির্বাচন করা হয়। গত ১২-১৬ মার্চ থেকে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ঢিবি (শিংয়ের বাড়িতে) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে আনুষ্ঠানিকভাবে খননকার্যক্রম শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। প্রায় দু’ মাস খনন করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র ও মৃৎপাত্রের টুকরা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি, কলস, বাটি, থালা, বদনা, কড়াই, প্রদীপ প্রভৃতির শরীর , কান্দা, নলসহ বিভিন্ন ভাঙা অংশ। এ ছাড়া পোড়ামাটির ফলকের ভাঙা অংশ, পোড়ামাটির প্রতিমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ পাওয়া গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন