ঢাকা ও গুলশান ক্লাবসহ দেশের ১৩টি নামী-দামি ক্লাবে জুয়াজাতীয় খেলার ওপর তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত রোববার বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সামিউল হক ও অ্যাডভোকেট রোকন উদ্দিন ফারুকের করা রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট উক্ত আদেশ দিয়েছেন। একই সাথে জুয়াজাতীয় খেলা যেমন- কার্ড, ডাইস ও হাউজি অথবা এমন কোনো খেলা যাতে টাকা বা অন্য কোনো বিনিময় হয়ে থাকে তা বন্ধের নির্দেশনা কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার ঢাকা, খুলনা ও সিলেট এবং র্যাবের মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসক ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জকে নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
দেশের সংবিধান অনুযায়ী জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। রিটের পক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৮ এবং পাবলিক অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী কোনো প্রকার জুয়া খেলা দ-নীয় অপরাধ। জুয়া খেলা আইনত নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় একদিকে যেমনি অভিজাত ক্লাবগুলোতে তা বহাল রয়েছে তেমনি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শনীর নামে চলা মেলাগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। প্রতিবারই এসব প্রদর্শনীতে চলা হাউজি তথা জুয়ার নামে চলে নানা অপকীর্তি। এসবকে কেন্দ্র করে মারামারি, খুনোখুনির ঘটনাও কম হয় না। সেই সাথে চলে নগ্ন নৃত্যসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। দেখা যায় বিশেষ একশ্রেণীর লোকের কারণে এসব মেলা কার্যত হয়ে ওঠে বেলেল্লাপনার আড্ডাখানায়। বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন থেকেই কথাবার্তা হচ্ছে। আসলে এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এসব সাধারণত গ্রাম বা উপজেলা পর্যায়ের ব্যাপার। আলোচ্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দেশের নামী-দামি ক্লাবগুলোতে জুয়াজাতীয় খেলা নিষিদ্ধ করতে বলা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় যেসব ক্লাব রয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঢাকা ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, বনানী ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব, ঢাকা লেডিস ক্লাব, ক্যাডেট কলেজ ক্লাব গুলশান, চিটাগাং ক্লাব, চিটাগাং সিনিয়রস ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব ও খুলনা ক্লাব। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের কথিত অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাই এসব ক্লাবের সদস্য। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, এর বাইরেও আরো অনেক ক্লাব রয়েছে বা থাকতে পারে, যেখানে সমাজের নামী- দামি মানুষেরা বসেন, আড্ডা দেন এবং অনেকে জুয়ার নেশাতেই আসর জমান। আবার হয়তো দেখা যাবে এই নিষেধাজ্ঞার পর রাতারাতি কোনো কোনো ক্লাবের জন্ম হবে বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, যারা এতদিন পর্যন্ত দেশের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে জুয়া খেলে আসছিল তারা রাতারাতি ভালো হয়ে যাবে। অনেক দিন থেকেই এ খেলা চলে আসছে। এ কারণেই এ ধরনের অনেক ক্লাবের নির্বাচনে প্রচুর টাকার খেলা হয়। প্রধানত ক্লাবগুলো সুস্থ বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকলেও সেটা যে মুখ্য নেই সে কথাই প্রমাণিত হয়েছে উচ্চতর আদালতের আলোচ্য নির্দেশনায়। এটা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। আদালতের নির্দেশনায় শুধু এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতেই নয়, বরং খেলা আয়োজনকারীদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। দেশে যখন অপসংস্কৃতির বন্যা বইছে, প্রতিনিয়ত যখন ধর্ষণ, ব্যভিচার বাড়ছে, মাদকসহ নানা নেশার পণ্য যখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে সেসময়ে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম উপাদান জুয়া বন্ধের এই নির্দেশনাকে সময়োপযোগী অভিহিত করাইঅধিক সমীচীন। অভিজাত শ্রেণীর ওপর যদি সত্যিই এটা কার্যকর করা যায় তাহলে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে তার অবসান কেবল সময়ের ব্যাপার।
উচ্চতর আদালতের জুয়া বন্ধের নির্দেশনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। এই নিষেধাজ্ঞা যাতে স্থায়ী হয় সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। ভাবতে অবাক লাগে দেশের সংবিধানে যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’ সেখানে এ ধরনের খেলা খোদ রাজধানীতে সবার চোখের সামনে কিভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে? হতে পারে এর সাথে বিভিন্ন মহলের কোনো না কোনোভাবে যোগসাজশ রয়েছে। জুয়ার টাকা তথাকথিত ফুর্তিতেই ব্যয় হয়। অন্যদিকে জুয়া খেলতে গিয়ে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। জুযার সাথে সঙ্গত বিবেচনাতেই অন্যান্য সামাজিক অপরাধের আন্তঃসংযোগ রয়েছে। জুয়া আমাদের সমাজের সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী। সমাজকে সামগ্রিকভাবে গ্রাসকারী এই মারণ খেলা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাই যতœবান হবেন- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন