শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দুর্নীতি প্রতিরোধে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

মো. আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দুর্নীতি তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়, যাদের আছে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা। সে ক্ষমতা হতে পারে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক। ক্ষমতা যাদের হাতে আছে তারাই প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিবাজ হতে পারে। মূলত যার যত বড় ক্ষমতা, সে তত বড় দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। দেশে-বিদেশে ‘দুর্নীতি’ একটি বহুল আলোচিত শব্দ। বিশেষ করে, নিজ স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ, ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ আদায়, প্রতরণা, প্রভাববিস্তার, স্বজনপ্রীতি, সম্পদের অপব্যবহার, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, দায়িত্ব পালনে অবহেলাকে আমরা দুর্নীতি বলে থাকি। এছাড়া কখনো দারিদ্র্যের কারণে, কখনো লোভের বশবর্তী হয়ে, আবার কখনো দুর্নীতি করার সুযোগ আছে, কিন্তু শাস্তির সম্ভাবনা নেই, এইরূপ কারণে মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতিমাত্রা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বলে রাজনীতি এখন লাভজনক ইজারা নীতিতে পরিণত হয়েছে, যার লাভ ক্ষতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। শুধু মার-কাটো-খাও। দল কর, টাকা কামাও। জবাবদিহিহীন হওয়ার কারণে রাজনীতি এখন টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। ফলে, সমাজে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। দেশে রাজনীতির নামে হচ্ছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্যসহ বৈধ ও অবৈধ নানা ধরনের অপকর্ম। রাতারাতি টাকার মালিক হতে অনেকে রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কেননা, অন্য ব্যবসায় ঝুঁকি থাকলেও এই ব্যবসায় ঝুঁকি অনেকাংশে কম। আর ক্ষমতাশীন দলের নেতা-কর্মী হলে তো কথাই নেই। ফলে রাজনীতিতে ব্যবসায়িকদের উপস্থিতি দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংসদে এদের হার ছিল ১৮ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ শতাংশে। দলগুলোর মধ্যে স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে দলের জন্য তো বটেই দেশের জন্যে তা ভয়াবহ পরিণতির কারণ হতে পারে। যদিও এখন নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অসততার কারণেও প্রতিটি সেক্টরে কালো বিড়ালের অবির্ভাব ঘটছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশে সকল প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের সার্বিক কল্যাণে সদিচ্ছা থাকলেও সরকারের আশেপাশে বিরাজমান সুবিধাভোগীরা সরকারকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের রাজস্ব একপ্রকার হরিলুট হচ্ছে। তা রুখতে দেশে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আমলা, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক, কলামিস্টসহ সচেতন যুবসমাজ তথা সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দিতে কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতিকে ‘না’ বলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

তথ্য মতে, ২০১৮ সালে দুর্নীতিগ্রস্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী, বাংলাশের অবস্থান ১৪৯তম। অথচ, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ এই হিসেবে ছিল ১৪৩তম। অর্থাৎ এখানেও ৬ ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। ১৮০টি দেশের উপর টিআই এই জরিপ চালিয়েছে। জরিপে ০ থেকে ১০০ নম্বরের স্কেলে দেশগুলোকে নম্বর দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম নম্বর (১০ স্কোর) পেয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়েছে সোমালিয়া। তার পরেই রয়েছে (১৩ স্কোর) সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদান। তৃতীয় অবস্থানে (১৪ স্কোর) রয়েছে ইয়েমেন ও উত্তর কোরিয়া। ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ নম্বরে। এর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৪৩ নম্বর অবস্থানে। আর সবচেয়ে বেশি (৮৮ স্কোর) পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বিবেচিত হয়েছে ডেনমার্ক। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এর পরেই রয়েছে (৮৭ স্কোর) নিউজিলন্যান্ড। তৃতীয় অবস্থানে (৮৫ স্কোর) রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও সুজারল্যান্ড। প্রসঙ্গত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান (১৬ স্কোর)। আর সবচেয়ে কম দুর্নীতি ভুটানে (৬৮)।

এই ভয়াবহ অবস্থা মূল কারণ হচ্ছে, বর্তমানে দেশে যেসব উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বা অভিযুক্ত অথবা দুর্নীতি করেছেন, খুব কম ক্ষেত্রেই তারা বিচারের মুখোমুখি হয়েছে, যা দুঃখজনক। যদিও দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান বৈশ্বিক অবস্থানের চেয়ে অনেক নিচে। তাই বলে আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। কেননা, আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনার বিষয়টি শুধুমাত্র দুর্নীতির কারণে আটকে আছে। দ্রুত এই অবস্থার অবসান হওয়াটা জরুরি।

বর্তমান বাস্তবতায় বলতে হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলির জনগণের প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ঘোষণা বাস্তবায়নে অধিক উদাসীনতা। বিপরীতে উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদের যথাযথ বিচারের আওতায় না আনা ও শাস্তি না হওয়া । দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ভয়াবহ দুর্নীতি, ব্যাংক খাতে অবারিত দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা, জালিয়াতি, ভূমি-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কারণে দুর্নীতি এক ধরনের ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকট। আমাদের প্রশাসনে, সরকারি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও ব্যক্তি অবস্থানকে ব্যক্তিস্বার্থের জন্য প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

যদিও বলতে গেলে বর্তমানে দুর্নীতিগ্রস্ত বেশ কয়েকটি সেক্টরের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে, যা সংবাদপত্রে দৃশ্যমান। আমাদের ব্যাংকিং ও ফাইনান্স সেক্টরে দুর্নীতি একেবারে স্পষ্ট। এখানে ব্যাংক জালিয়াতি, ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, রাজনৈতিক প্রভাব, সারাদেশে বিভিন্নভাবে ভূমি সেক্টরে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় ক্রয়খাতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্রমবর্ধমানহারে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের দৃষ্টান্ত খুবই খারাপ। অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করে টাকা ফেরত আনাসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে।

আমরা মনে করি, যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের সঠিক প্রয়োগ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সুশাসন নিশ্চিত হবে না, দুর্নীতি প্রতিহত করা যাবে না। গত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এরই মধ্যে আমরা সাফল্য পেতে শুরু করেছি। জনগণের প্রত্যাশা, এবার তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। বলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কারো এদেশে ঠাঁই হবে না। তার ওই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করি। এখন বাস্তবায়নের পালা। আমার বিশ্বাস করি, দুর্নীতি প্রতিহত ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপই নেবেন, জনগণ তাতে সার্বিক সহায়তা দেবে।

এক্ষেত্রে আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে দুর্নীতি প্রতিহত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানো যাবে না, বরং প্রতিহত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারো কোনো তদবির মানা যাবে না। নিজ নিজ জায়গা থেকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং কঠোর হতে হবে তাহলেই অধস্তনরা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না। তাই আগে নিজেকেই ঠিক হতে হবে। এক্ষেত্রে আমি যদি অনিয়ম না করি, তাহলে অফিসের অন্যরাও অন্যায়-অনিয়ম করার সাহস পাবে না। এভাবে একে একে বদলাবে সবাই। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের জবাবদিহির ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। কাউকে বড় কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়ার আগে তার যোগ্যতা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা, সততা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে। সেসব জায়গায় ভালো কাজ হয় না। তার দুর্বলতার সুবাদে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। এবিষয়ে নজর দিতে হবে। বাস্তবায়নে প্রত্যেক সেক্টরে জবাবদিহি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি রোধ ও সুশাসনের জন্য যত রকম পন্থা আছে সেটা প্রয়োগ করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন