বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ‘হত্যাকাণ্ড শূন্যে’ নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও ভারত তা রক্ষা করছে না। বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এমন কোনো মাস নেই যে মাসে বিএসএফ বাংলাদেশীদের ওপর নির্যাতন ও গুলি চালায় না। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফররত, তখন সফরের শেষ দিনে দিনাজপুর সদর উপজেলার দাইনুর সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে এক বাংলাদেশীকে হত্যা এবং দুইজনকে আহত করেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সফরে মোদীর সঙ্গে বৈঠকেও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার আলোচনা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দুই দেশের সরকার প্রধানদের আলোচনা ও ঐকমত্যের কোনো তোয়াক্কাই করছে না ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বজিবি বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তে বিজিবি আদৌ আছে কিনা, পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত। বাংলাদেশীদের প্রতি বিএসএফ-এর বিরূপ আচরণ, গুলি ও নির্যাতনের কারণে এই সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তরফ থেকে। বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করলেও তার বিচার হতে দেখা যায় না। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএফ সীমান্তে ১৫ বছরের বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুনকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনা বিশ্বে আলোড়ন তুললেও তার বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ বছরে প্রতি বছর গড়ে ৬২ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। বিশ্বের আর কোনো দেশের সীমান্তে বছরে এত হত্যাকাণ্ড দেখা যায় না। এসব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য, বিএসএফ বরাবর নিহতদের গরু ও মাদক চোরাকারবারি হিসেবে আখ্যায়িত করে। দিনাজপুরে বিএসএফ-এর হত্যাকাণ্ডের শিকার রাজমিস্ত্রীর যুগালী কাজ করা তরুণের মা দুঃখ ও আফসোস করে বলেছেন, আমার ছেলেকে এখন তারা চোরাকারবারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। দুঃখের বিষয়, সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা এবং নির্যাতন করলেও বিজিবি এর কোনো প্রতিউত্তর বা প্রতিরক্ষা দিতে পারছে না । জনগণের করের বিপুল অর্থ ব্যয়ে এই বাহিনী পোষণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও বছরের পর বছর ধরে সীমান্তে জনগণের নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, এরচেয়ে সীমান্তে আনসার নিযুক্ত করাই ভালো। বিএসএফ কোনো বাংলাদেশীকে হত্যা করলে তার লাশ এবং নির্যাতন বা ধরে নিয়ে গেলে তাকে ফেরত আনার চিঠি চালাচালির মধ্যে বিজিবির দায়িত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা বিধানে তার তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। বিএসএফ যখন গুলি করে তখন তারা কোথায় থাকে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজিবি বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেও বিএসএফ-এর সাথে রাখীবন্ধন ও মিষ্টি বিনিময় করে আনন্দ করতে দ্বিধা করে না। পর্যবেক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, বিজিবি সীমান্তে নিস্ক্রিয় হলেও, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মসূচি দমাতে এমনকি গুলি করতে খুবই সক্রিয় ও তৎপর। পরিতাপের বিষয়, সীমান্তে বিএসএফ ক্রমাগত বাংলাদেশীদের হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অপহরণ করে নিয়ে গেলেও দেশের তথাকথিত স্বাধীনতার চেতনাধারীরা টুঁ শব্ধটি পর্যন্ত করে না। এ নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো ধরনের প্রতিবাদ করা হয় না।
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার ভারত মানছে না এবং মানবে বলেও মনে হয় না। যখন-তখন গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা করা থেকেই তা বোঝা যায়। অথচ সরকারের তরফ থেকে প্রতিনিয়ত ভারতের সাথে বন্ধুত্ব স্বর্ণশিখর উপনীত হয়েছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। ভারতও বন্ধুত্ব নিয়ে উল্লসিত। অথচ সীমান্তে যে আমাদের জনগণকে তার সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি করে হত্যা করছে, এ নিয়ে কোনো কথা নেই। এটা কি ধরনের বন্ধুত্ব? ভারতের সাথে ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, চীন, মায়ানমারেরও সীমান্ত রয়েছে। বিএসএফ বাংলাদেশীদের ওপর যেভাবে নির্বিচারে গুলি, হত্যা, নির্যাতন ও অপরহরণ চালায়, সেসব সীমান্তে কি তা করতে পারে? পারে না। এর কারণ, আমাদের সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি এবং সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা। ফলে পর্যবেক্ষকরা বরাবরই সীমান্তে বিজিবি’র দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, যদি এ বাহিনী সীমান্ত সুরক্ষা এবং বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তবে তাদের থাকা না থাকা একই কথা। আমরা মনে করি, দেশের সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবিকে আরও সক্ষম এবং কার্যকর করে তোলা প্রয়োজন। বিজিবিকে বিএসএফ-এর অন্যায় আচরণ প্রতিরোধ করার মতো সক্ষম করে তুলতে হবে। সীমান্তনিরাপত্তা নির্বিঘ্ন ও বাংলাদেশীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিএসএফ-এর গুলিতে যেসব বাংলাদেশী নিহত হয়েছে তাদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন