শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভাঙন থেকে দুই সমুদ্র সৈকতকে রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিরল সৈকত কুয়াকাটা মারাত্মক ভাঙনের কবলে পড়েছে। সৈকত ভাঙছে এবং সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে সৈকতের অস্তিত্ব ও সৌন্দর্য দুয়েরই বিপন্নতা ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর কুয়াকাটার সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ বেড়েছে। একারণে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক কুয়াকাটায় উপস্থিত হচ্ছে। তাদের জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, এখানে অবশ্য তার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে সৈকতের অব্যাহত ভাঙন তাদের হতাশ করছে। ইতোমধ্যে ঢেউয়ের প্রচণ্ড আঘাতে বিলীন হয়ে গেছে এলজিইডির ডাকবাংলা, জাতীয় উদ্যানের অধিকাংশ এলাকা ও নারিকেল বাগান। বিলীন হওয়ার মুখে রয়েছে মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন মার্কেট। পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালীর মতে, গত বছর ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে সৈকত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তরফে সাগরের ভেতর দিকে পূর্ব-পশ্চিমে জিওটিউব দিয়ে দুই কিলোমিটারের মতো প্রতিরোধক নির্মিত হয়েছে। এটা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। তাই খুব বেশি কাজে আসছে না। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা যায়, এমন ব্যবস্থাই কাম্য। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বেড়িবাঁধের বাইরে ছোট বড় তিন শতাধিক স্থাপনা ও শতাধিক দোকানপাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কুয়াকাটার মতো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতও অব্যাহতভাবে ভাঙছে। এই সমুদ্র সৈকতে বছরে লাখ লাখ লোক ভ্রমণে আসে। তাদের সুযোগ-সুবিধার দিক খেয়াল করে সৈকত ঘিরে গড়ে উঠেছে ডজন খানেক পাঁচ তারকা হোটেলসহ চার শতাধিক হোটেল-মোটেল। প্রতিবছর এসব প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ সৈকতের আগের অবস্থা ও সৌন্দর্য দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থান ও পয়েন্ট। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাবনী পয়েন্ট ভেঙে তছতছ হয়ে গেছে। একের পর এক বিলীন হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। হুমকির সম্মুখীন আরো বহু প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও স্থান।

ইনকিলাবে প্রকাশিত কিছুদিন আগের এক খবরে জানা যায়, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের যেসব সরকারি-বেসরকারি ভবন, স্থাপনা ইত্যাদি অধিক হুমকির সম্মুখীন, তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ডায়াবেটিকস হাসপাতাল, ট্যুরিস্ট পুলিশ ভবন, আর্মি রেস্ট হাউস, বিজিবি রেস্ট হাউজ, হোটেল সীগাল, হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইস, হোটেল সায়মনসহ হোটেল-মোটেল জোনের ১৫-২০টি তারকা মানের হোটেল। একইভাবে কলাতলী, হিমছড়ি, ইনানী, মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদিও ভাঙনের মুখে। কক্সবাজারকে পর্যটন নগরী বলা হয়। প্রতি বছর যত দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসে, আর কোনো পর্যটন কেন্দ্র বা স্থানে তত পর্যটকের আগমন ঘটে না। এ কারণে কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীত করা হয়েছে। এজন্য বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। ভাঙন থেকে বিমানবন্দর রক্ষা করা না গেলে বিমান বন্দর নির্মাণ-উন্নয়নে ব্যায়িত অর্থ বিফলে যাবে। অনুরূপভাবে পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সুরক্ষার আশু ব্যবস্থা না নিলে এর জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাও কোনো কাজে আসবে না। ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের একদিকে সাগর অন্যদিকে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। এ এক অনন্য সৌন্দর্য। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ সড়ক ব্যবহার করে, সৌন্দর্য উপভোগ করে। মেরিন ড্রাইভ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর নির্মাণ করেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ভাঙনের কারণে এই অপার সৌন্দর্যের আধার সড়কটি এখন অস্তিত্ব সংকটে পতিত। পর্যবেক্ষকদের মতে, সৈকত থেকে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল এবং সাগরের উচ্চ ঢেউয়ের আঘাত এ জন্য দায়ী। সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা যেমন তলিয়ে যাচ্ছে, তেমনি জোয়ারে মেরিন ড্রাইভের অংশবিশেষ ও ডুবে যাচ্ছে। কলাতলী থেকে সাবরং পর্যন্ত এলাকা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ। সৈকতের এই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে অপরিকল্পিত নির্মাণও দায়ী বলে অনেকে মনে করেন।

কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বর্তমান অবস্থার কারণ প্রায় অভিন্ন। এ ধরনের সৈকত বা পর্যটন কেন্দ্রের প্রতি যে রূপ সর্বক্ষণিক মনোযোগ ও নজরদারি আবশ্যক, দুঃখজনক হলেও তার অভাব রয়েছে। দুই সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রিক স্থাপনাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। অথচ সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে এজন্য বড় অংকের বিনিয়োগ হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগের অর্থের যোগান এসেছে জনগণের ট্যাক্স থেকে। বেসরকারি বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীদের কষ্টার্জিত উপার্জন ভূমিকা রেখেছে। সৈকত সুরক্ষার অভাবে এই বিপুল বিনিয়োগ অকেজো হয়ে যাবে, সেটা কারো প্রত্যাশিত হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাগরে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢেউয়ের গতি চন্ড রূপ নিয়েছে। সবকিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সাগরের এ বিরাগ প্রতিরোধে স্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সৈকত থেকে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন অবশ্যই রোখা যায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে। সেটা নেয়া হচ্ছে না কেন? সাগরের গ্রাস থেকে সৈকত ও সম্পদ রক্ষা করতে হবে। অপরিকল্পিত স্ট্রাকচার নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। কার্যকর নজরদারি নিয়মিত করতে হবে। কীভাবে সৈকত নিরাপদ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। অন্যান্য দেশে এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় কী গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে তা দেখতে হবে। দুই সমুদ্র সৈকত শুধুমাত্র সমুদ্র সৈকত নয়, পর্যটনের দুটি বড় কেন্দ্রও। এর অস্তিত্ব ও আকর্ষণ ধরে রাখতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Kamal Pasha Jafree ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:০১ এএম says : 0
তিন বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে ভাঙন। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এটা হচ্ছে, যা জোয়ারের কারণে বড় আকার ধারণ করেছে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিশেষ করে সাগরের স্বাভাবিক গতিকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই বর্তমানে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছে।
Total Reply(0)
Ismail Sagar ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:০২ এএম says : 0
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করার পর যে নিষেধাজ্ঞা পালন করা উচিত ছিল, সেগুলো করা হয়নি। উল্টো ঝাউবন উজাড় করা হয়েছে, সাগর লতার প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। সৈকতের ৩০০ মিটারের মধ্যে ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ না করতে আদালত ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) আদেশ অমান্য করা হয়েছে।
Total Reply(0)
Antara Afrin ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:০৩ এএম says : 0
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বাঁধ ভাঙনের অন্যতম কারণ। এই বাঁধের কারণেই সমুদ্র তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পর্যটন ও পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন