এ কথা ঠিক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের প্রাপ্তি উল্লেখ করবার মতো নয়। কিন্তু তাই বলে এ কথাও ঠিক নয় যে, আওয়ামী লীগের ওপর ভারত সরকার খুশি নয় বলে প্রধানমন্ত্রী এবার কিছু আনতে পারেননি। গত রবিবার বাংলাদেশের অন্তত দুইটি বাংলা দৈনিকে সেই কথাই বলা হয়েছে। দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম, ‘আওয়ামী লীগের ওপর খুশি নয়, তাই কিছুই আনতে পারেননি- মির্জা ফখরুল’। দৈনিক সমকালের শিরোনাম, ‘এই সরকারের ওপর খুশি নয় ভারত- মির্জা ফখরুল’। দুটি পত্রিকাতেই প্রথম পৃষ্ঠায় এই খবরটিকে সেকেন্ড লিড অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রধান সংবাদ হিসাবে ছাপা হয়েছে। সমকালের খবরে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত এখন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর খুশি নয়। নৃত্যগীতে ভরপুর একটি সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ যখন মারা যাচ্ছেন, যখন গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, তখন তারা জয়পুর বিমান বন্দরে গিয়ে নাচানাচি করেছেন। দেশের মানুষ এটা ক্ষমা করবে না।’ ভারত সরকার যে খুশি নয় সে বিষয়টি এর চেয়ে বেশি আর ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। দৈনিক যুগান্তরের খবরে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে বলেছেন, ভেবেছিলাম প্রধানমন্ত্রী এবার ভারতে গেছেন তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি সমাধান হবে। অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা পাবো। সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে। আমাদের বাণিজ্যে যে ব্যবধান আছে তা আরো কমে আসবে। আরো সুযোগ-সুবিধা তিনি (প্রধানমন্ত্রী) নিয়ে আসতে পারবেন। তিনিও যে আশা নিয়ে গিয়েছিলেন ভারত সেগুলো দিয়ে দিবে। ভারত তো এখন তাদের (আওয়ামী সরকার) ওপর খুশি নয়। তাই তিনি কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি।’ দুটি পত্রিকাই এর বেশি কিছু আর বলেনি।
মির্জা ফখরুলের এই মন্তব্যের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নাই। আমার কাছে এ ধরনের কোনো খবর নাই। আমি বরং প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাওয়ার আগে ভাবছিলাম যে, তিনি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ১৫ মাস আগে এবং ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনের দেড় বছর আগে কেন ভারত যাচ্ছেন? তিনি সর্বশেষ ভারত গিয়েছিলেন ২০১৯ সালের অক্টোবরে। সেটিও সংবাদপত্রের বক্তব্য মোতাবেক ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলির আমন্ত্রণে। এবার এই বিষয়টি আমার কাছে প্রথম থেকেই পরিষ্কার ছিল যে, তিস্তার পানি নিয়ে এবার কিছু হবে না। আর প্রধানমন্ত্রী ভারতে পৌঁছার ২/৩ দিন আগে থেকেই ৭ দফা সমঝোতা স্মারকের যে, খসড়া বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের কথা ছিল। কিছু কিছু পত্রিকায় পরিষ্কার বলা হয়েছিল, তিস্তা নিয়ে চুক্তি হওয়া তো দূরের কথা, সেটি নিয়ে কোনো আলোচনাও হবে না। বাস্তবে হয়েছে ঠিক তাই।
বাংলাদেশের মানুষের একটি প্রত্যাশা ছিল এই যে, এবার হয়তো সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের হত্যা হয়তো বন্ধ হবে। যুক্ত ইশতেহারে সেই ধরনের একটি প্রত্যাশাও ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারতের মাটিতে ছিলেন তখনও বিএসএফের গুলিতে দিনাজপুরের এক তরুণ নিহত হয়েছেন। তাহলে যুক্ত ইশতেহারে ঐ ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করার অর্থ কী? যে ৭ দফা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলো কিন্তু কোনো চুক্তি নয়। চুক্তি পালনের জন্য চুক্তিবদ্ধ দুটি দেশের ওপর যে বাধ্যবাধকতা থাকে, সেই বাধ্যবাধকতা সমঝোতা স্মারকে থাকে না। যে কোনো পক্ষ ইচ্ছে করলেই সমঝোতা স্মারক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সমঝোতা স্মারকে যেটি হাইলাইট করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি হলো কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন। এটি কিন্তু বাংলাদেশের কাছে বড় কোনো এজেন্ডা ছিল না। কুশিয়ারা থেকে বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না, এমন অভিযোগও ছিল না। তাহলে হঠাৎ করে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের কথা এলো কেন? এ ব্যাপারে এক শ্রেণীর নদী বিশেষজ্ঞ বলেন যে, সেই যে ২৫ বছর আগে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তারপর অবশিষ্ট ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারত এবার দেখালো যে, ঐ ৫৩টি নদীর পানির ব্যাপারে এখন তারা সিরিয়াস। আসলে ঘটনা কি তাই?
॥দুই॥
ঘটনা আসলে অন্যরকম। গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে চুক্তি তো ২৫ বছর আগে হয়েছে। এরমধ্যে ভারতকে আরেকটি নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে। সেটি দেওয়া হচ্ছে কোনো রকম চুক্তি ছাড়াই। ফেনী নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম জেলায়। বলা হয়েছে যে, স্থানীয় যে পানি রয়েছে সেখানে এত বেশি আয়রন যে সেটা পান করার মতো নয়। সেজন্য ফেনী নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে। সেটাকে পিওরিফাই করে সাবরুম জেলার মানুষ পান করছে। ঠিক সেই সময়টাতেই বাংলাদেশের মানুষ আরেকবার প্রশ্ন তুলেছিল, ওদেরকে তো ফেনী নদীর পানি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের তিস্তা নদীর পানি কই? সেজন্যই ২৫ বছর পর হঠাৎ করে কুশিয়ারা নদীর পানি সামনে এলো। আসলে আমাদের অবস্থা হলো, ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম/ টাক ডুমা ডুম ডুম’।
বি এম আব্বাসের পর বাংলাদেশে যাকে পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিবেচনা করা হয় তার নাম ড. আইনুন নিশাত। এবার ড. নিশাত অভিন্ন নদী সম্পর্কে দারুণ একটি তথ্যবোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৩ বা ৫৪ নয়। এটির সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০। তিনি দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন সর্বাগ্রে ঠিক করুক যে, উভয় দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহমান অভিন্ন নদীর সংখ্যা কত। এটি নির্ধারণের পরেই তারা বসুন সেই সব নদীর পানি কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়। আগেই বলেছি যে, ড. নিশাত এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সকলের কাছে বিবেচিত সবচেয়ে বড় নদী বিশেষজ্ঞ। তার কথাকে বাংলাদেশ সরকারের অবশ্যই আমলে নেওয়া উচিত। আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো, ঐ ৭ দফা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি আবশ্যকীয় ছিল না। সচিব পর্যায়েই এগুলো স্বাক্ষরিত হতে পারতো। তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলেকশনের ১৫ মাস আগে ৪ দিনের দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ধার করে বলছি, ‘এব্যাপারে কোনো পক্ষই ঝেড়ে কাশছেন না।’ এই রকম ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের মধ্যেও বাংলাদেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির মালিকানাধীন বাংলা পত্রিকাটি কিছুটা হলেও ঝেড়ে কেশেছে।
পত্রিকাটির নাম সমকাল। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ১ দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম পৃষ্ঠায় ঐ পত্রিকা একটি এক্সক্লুসিভ খবর ছেপেছে। খবরটির শিরোনাম, ‘ঢাকার মধ্যপন্থায় আশ্বস্ত দিল্লী/ ভারত সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী’। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ঐ খবরে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে উঠে আসে পারস্পারিক স্বার্থ ও ভূ-রাজনীতি। সেখানে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্তে অপরাধ, জঙ্গিবাদ ও সামরিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে জানিয়েছে ভারত। তবে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় এই অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারত যে উদ্বেগ জানিয়েছে তার জবাবে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির কথাই বলেছেন বাংলাদেশ। এখানে অন্য কারো উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা জাগতে পারে, বাংলাদেশ সেই নীতিতে বিশ্বাস করে না। এই কথাটিই পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।’
রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশে কোনো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ হতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে ঢাকা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামরিক খাতে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ভারতের নিরাপত্তায় কোনো ঝুঁকি তৈরি করে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না বাংলাদেশ- এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে বৈঠকে।’ রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত। সে ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।’
বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘দুই দেশের কৌশলগত অগ্রাধিকারে ভারতের আগ্রহ ও উদ্বেগ এবং বাংলাদেশের আগ্রহ ও অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ ভারতের সিনিয়র অফিসার বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভারত থেকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ঋণের আওতায়।
আলোচ্য রিপোর্টের শেষে যা বলা হয়েছে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরটি অনেকেই চুক্তি ও সমঝোতার সংখ্যায় সফলতা ও ব্যর্থতার দিকে মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু এ সফরটি চাওয়া পাওয়ার কোনো সফর ছিল না। সফরটি ছিল মূলত কৌশলগত দিক বিবেচনায়। বর্তমান বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেই চাপ সামাল দেওয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বোঝাপড়া করতেই এ সফর। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এটি মূলত কূটনৈতিক ও পারস্পারিক বোঝাপড়ার সফর। দুই দেশের সম্পর্ককে ঝালিয়ে নেওয়ার বিষয় ছিল সফরের মধ্যে। সম্পর্কে আরো আস্থা ও গতি সঞ্চারই ছিল প্রধান বিষয়। সেই চেষ্টাই করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মূল্যায়ন ওপরে যেভাবে করা হয়েছে তার সাথে ভারতের নামীদামি পত্রিকা ‘হিন্দুস্তান টাইমসের’ একটি সংবাদ মিলে যায়। ৬ সেপ্টেম্বর ঐ পত্রিকার ভাষ্যকার শুভজিৎ রায় লিখেছেন, Can resolve all problems with Modi at helm in India: Bangladesh PM Sheikh Hasina. After the two sides signed a pact on water-sharing on the Kushiyara river, Modi said the agreement will benefit people in southern Assam and Sylhet in Bangladesh. অর্থাৎ মোদি যদি ক্ষমতায় থাকেন তাহলে ভারত এবং বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান করা যাবে। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির পর নরেন্দ্র মোদি বলেন, এই ঐক্যমত দক্ষিণ আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেটের জনগণের উপকারে আসবে। প্রত্যুত্তরে শেখ হাসিনা বলেন,As long as Prime Minister Narendra Modi is around, New Delhi and Dhaka will find a solution to all bilateral problems, including the Teesta River water-sharing issue, visiting Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina said Tuesday. অর্থাৎ যতক্ষণ মোদি আছেন ততক্ষণ তিস্তার পানি বণ্টনসহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান হবে।
এসব বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে, ভারত ও বাংলাদেশের শীর্ষ দুই নেতার ভেতর ব্যক্তিগত Rapport সৃষ্টি করাই ছিল এই সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এখন সেই উদ্দেশ্য কতখানি সফল হয়েছে সেটা বলবে অনাগত ভবিষ্যৎ।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন