বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে হবে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিরূপ প্রকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন, কথিত সীমানা পিলার চুরি হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে বাড়ছে বজ্রপাতর সংখ্যা; বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাত এখন ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। বজ্রপাতে একাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে এখন। একসাথে ১৬ জনের মৃত্যুর খবরও ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। গত ৮ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মাটিকোড়া এলাকায় বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা ৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ঘটনায় আরও ৮ জন আহত হয়েছে। এত মৃত্যু, তারপরও রাষ্ট্র কতটা ভাবছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বজ্রপাত নিয়ে দেশে তেমন গবেষণা নেই। বজ্রপাত নিরোধে উদ্যোগও ধীরগতিতে চলছে। বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক কথিত সীমানা পিলার একে এক উধাও হলেও রাষ্ট্র সরব নয় কেন?
বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এতে সারাবিশ্বে বছরে ২৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে বাংলাদেশে ঠিক কতো মানুষের মৃত্যু হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, এই সংখ্যা দেড়শ’ থেকে দু’শোর মতো। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ জনের মৃত্যু হচ্ছে। গত এক যুগে এ সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন। ২০২২ এর জুনে এক মাসেই দেশের ১৩ জেলায় ৩১ জন নিহত হয়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এ হিসাবে বজ্রপাতে মৃত্যুও দিক থেকে বাংলাদেশের নামটি উঠে এসেছে এক নাম্বারে।
বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়। তারা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে। এপ্রিল থেকে মে-জুন পর্যন্ত বজ্রপাতের মৌসুম। তবে এখন দেখা যায়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একজন মৃত্যুর সঙ্গে অন্তত ১০ জন আহত হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বজ্রপাতে আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তাদের গবেষণা বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১৯৭৮ জন এবং তাদের ৭২ শতাংশই কৃষক। তাদের বেশির ভাগই খোলা মাঠ ও খেত অথবা হাওরের মধ্যে কৃষিকাজ করছিল। বিপুল মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, হঠাৎ কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতজনিত কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ারর ব্যাপারে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে আবহাওয়াবিদ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে তা হলো, ব্রিটিশ শাসনামলে মাটির নিচে মৌজা, জেলা, উপজেলার সীমানা নির্ধারণী ধাতুর পিলার নির্বিচারে চুরি হওয়ার কারণে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলছে। এটি কোনভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ শাসনামলের সীমানা পিলার চুরি হওয়ার পর থেকেই দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং আহত-নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা জায়, ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে বিভিন্ন স্থানে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটির নিচে পিলারগুলো পুঁতে রাখা হয়েছিল এই ‘ম্যাগনেটিক পিলার’ স্থাপন নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক পিলার’ বলে আখ্যায়িত করছেন। একটি ‘ম্যাগনেটিক পিলার’ মানে কাজ না করে ঘরে বসে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া। আবার কেউ কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা আসলে এদেশের সব গোপন তথ্য চুরি করে নিয়ে যায়। এটা অমূলক কথা। তবে আসল ঘটনা হচ্ছে, এদেশে ব্রিটিশ শাসনের (বর্তমান বাংলাদেশের) সময়কালে সীমানা পিলারগুলো ফ্রিকুয়েন্সি অনুযায়ী একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব মেপে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। যেগুলো পিতল, তামা, লোহা, টাইটেনিয়ামসহ ধাতব চুম্বক সমন্বয়ে গঠিত। এ কারণে বজ্রপাত হবার সময়ে ইলেকট্রিক চার্য তৈরি হয় সেটি সরাসরি এই পিলারগুলো শোষণ করে আর্থিংয়ের কাজ করতো। এতে করে বজ্রপাত হতো কিন্তু মানুষ মারা যেতো না।
বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রচারণা রয়েছে, এ পিলারগুলো ‘মহামূল্যবান’। ওইসব বিষয়কে পুঁজি করে কিছু অসাধু লোক এই পিলারগুলো অনেক দামে বিক্রি করা যায় এ রকম গুজব ছড়ায়। এ কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পিলারগুলো রাতারাতি নিশ্চিহ্ন করে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এমনকি ভারতেও এই সীমানা পিলার নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা। এটি আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রও হতে পারে। তা সরকারকে তলিয়ে দেখা প্রয়োজন ছিল। এক শ্রেণির অসাধু মানুষ রাতের অন্ধকারে পিলার এখনও নিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। পিলার চুরি করার ও পিলারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ারও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। পিলার চুরির বিভিন্ন চক্র এখনও সক্রিয় রয়েছে। এ বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব সহকারে কেন নিচ্ছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা ধাতুর সীমানা পিলার নির্বিচারে তুলে নেওয়ার কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে মানুষের মধ্যে এ ধারণাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম খান জাতীয় দৈনিকে বলেন, ‘ব্রিটিশ শাসকরা হয়তো ওটা সীমানার জন্য দিয়েছিল কিন্তু ইট হেল্প দ্য লাইটনিং টু ডাউন আর্থ। লাইটনিং অ্যারেস্টারটাও (বজ্র নিরোধক দণ্ড) কিন্তু মেটাল দিয়ে মাটির নিচে পুঁতে দেওয়া হয়, যাতে বজ্র দালান থেকে মাটিতে যায়। ‘লাইটনিং (বজ্র) যাতে মাটিতে চলে যায় সেজন্য হয়তো ওই পিলারগুলো হেল্প করতো। সেগুলো যদি উঠিয়ে নেওয়া হয় তবে তো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা নষ্ট হয়ে যেতেই পারে। যদিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিতভাবে এটা বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেছেন, ‘ওয়েদার প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে গেছে। মে মাসে যে বৃষ্টি বৃদ্ধি হয় তা এপ্রিল মাসে হলো। ফেব্রুয়ারিতে শীত পাওয়া গেল না। মেঘ অসময়ে বেশি হচ্ছে, বাতাসে মনে হয় ধূলিকণার পরিমাণও বেশি, চার্জও বেশি হচ্ছে। এজন্য হয়তো হাইভোল্টেজ বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। তবে আগে এত মৃত্যুর কথা আমরা শুনতাম না। দেশে বজ্রপাতে এত মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরও ‘আমাদের দেশে বজ্রপাত নিয়ে মৌলিক গবেষণা হয়নি। লাইটনিং নিয়ে গবেষণার জন্য কোনো গ্রুপও বাংলাদেশে নেই।’ রাষ্ট্রের এমন উদাসীনতা আমাদের হতাশ করে বৈকি!
একটু আশার কথা হলো, বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সম্প্রতি অ্যারেস্টর বা বজ্রপাতনিরোধক যন্ত্র এবং আগাম সতর্কীকরণ যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া সরকার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মতো বজ্রপাত আশ্রয়কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করেছে। ৪৭৬ কোটি টাকার ঐ প্রকল্প মূলত দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে দীর্ঘদিন আগে এই উদ্যোগ গৃহীত হলেও তাতে গতি নেই। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে হাওরাঞ্চলসহ দেশের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রনিরোধক বা অ্যারেস্টর বসানোর জন্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা বেশ কয়েক বছর ধরে পড়ে আছে একনেক বৈঠকে অনুমোদনের অপেক্ষায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রকল্প নেওয়া হবে হাওর এলাকায়। কারণ, হাওরে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। প্রথমে ১৫টি স্থানে বজ্রনিরোধক বা অ্যারেস্টর বসানো হবে। এই উদ্যোগ সফল হলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে আসবে। এটি খুব বেশি জরুরি সরকারকে আর বিলম্ব করলে চলবে না।
আবহাওয়াবিজ্ঞানীদের আরও একটি তথ্য হলো, বজ্রপাতের অন্যতম কারণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় অন্তত ১২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোবাইল ফোন ব্যবহার বৃদ্ধি, অতিরিক্ত জনঘনত্ব ও বজ্রপাত মৌসুমে মাঠে-ঘাটে এবং জলাশয়ে মানুষের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বেড়েছে। এতে উঠে আসছে মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য। বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে অবকাঠামোগত প্রস্তুতির পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। বিশ্বের দেশে দেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুতই যথেষ্ট। যে কোনো মূল্যে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যবইয়ে এর কারণ এবং এ থেকে রক্ষা পেতে করণীয় বিষয়ে পাঠদান জরুরি। বজ্রপাত রোধে সারাপদশে মাঠে মাঠে বজ্রনিরোধক টাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। গাছ রোপণ করতে হবে। আর হাওর অঞ্চলে যেহেতু বজ্রপাত বেশি হয়, সেখানে প্রচুর ছাউনি নির্মাণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন