শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পৃথিবীর আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা

মুফতী আব্দুল হালীম কাসেমী | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
গুণীজন বলেন যে, দুই জিনিসের সূচনা নির্ণয় করা যায় না। অধঃপতনের শুরু আর ঘুমের সূচনা। কোনো দেশের শাসক ও শাসিত যখন নানা পন্থায় অধঃপতিত পন্থায় এগুতে থাকে এবং যাদের সমাজের স্তরে স্তরে দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের কারবার পল্লবিত, জানা কথা অনিবার্যভাবে তারা নানাবিধ দুর্যোগে পতিত হবে। ধরুন-বাংলাদেশের অবস্থা। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন মুসলমান হলেও অর্থনীতির চাকা কিন্তু ঘুরছে সুদি পন্থায়। ইচ্ছা না থাকলেও নানা কায়দায় লোকজন সুদে জড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রাম কি শহর-সর্বত্র সুদের বিস্তার। এমন কোনো খাত নেই, যাতে সুদ থাবা মেলেনি। যে ক্ষুদ্র ঋণের ‘কল্যাণে’ বাংলার ‘কৃতী সন্তান’ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয় এবং ‘নাইট’ খেতাব লাভ করে, তার ছিদ্রপথে সুদ কিলবিল করছে। কেমন যেন এর মাধ্যমে সুদ বাংলার মাটিতে তার ষোলকলা পূর্ণ করল। আর এর মধ্য দিয়ে হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণীও পূর্ণ হলো- ‘(কেয়ামতের পূর্বে) মানুষ এমন এক সময়ে উপনীত হবে, যখন সবাই সুদ খাবে। কেউ যদি সরাসরি সুদ না খায়, তবে তার ধুয়া (ও প্রভাব) তাকে আচ্ছন্ন করবে।’ (আবূ দাঊদ, হাদীস : ৩৩৩৩) অর্থাৎ কেয়ামতের পূর্বে সুদি কার্যক্রম বা প্রভাব থেকে কেউ নিস্তার পাবে না। ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিং আপতত এর মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে। কারণ এতে না চাইলেও টাকা বাড়ে। বস্তুত, এ দেশ আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। লোকজন ধোঁকাবাজি করে, মিথ্যা কসম খায়, ছলছুতায় অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করে। অথচ হাদীসে এসেছে-এভাবে ঠকবাজি করলে উন্নতি শিখরে উন্নীত হওয়া যায় না; বরং উত্তরোত্তর অধঃপতনের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-‘(মিথ্যা) কসম পণ্যের কাটতি বাড়ায়; কিন্তু বরকত ও প্রাচুুর্য শেষ করে দেয়।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০৮৭) ‘মিথ্যা কসম পণ্যের বেসাতি বাড়ায়; কিন্তু লাভের গুড় খেয়ে ফেলে।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪২০৯)

শাসকের দায়িত্ব: বিশ^নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। রাষ্ট্রপ্রধান (ও শাসকবর্গ) দায়িত্বশীল। প্রজাকুল সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৯৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৮২৮) এক হাদীসে রয়েছে, জনগণের কল্যাণ কামনা করা এবং তাদের কল্যাণে কাজ করা সরকারের দ্বীনি দায়িত্ব। অন্যথায় তারা গুনাহগার হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৫) ফিকহশাস্ত্রের অন্যতম মূলনীতি হলো-জনপ্রশাসন গণস্বার্থে হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ শাসকবর্গের কার্যক্রম ও প্রশাসন মেনে নেয়া জনগণের জন্য তখনই জরুরি, যদি সেগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূলে হয়। কারণ, প্রশাসনের লোকজন জনগণের সেবায় নিয়োজিত। তারা জনপ্রতিনিধি। কাজেই ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, জুলুম-অবিচার দূরীভূত করা, অধিকার ও চরিত্র রক্ষা করা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, দ্বীনি ও জাগতিক শিক্ষার প্রচার-প্রসার করা, জনগণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতে কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব। এসব বিষয় উপেক্ষিত হলে জনরোষ সৃষ্টি হবে, একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে, দুর্নীতি বিস্তার লাভ করবে, জনগণ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যাবে এবং প্রশাসনের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হবে। যেমন- চরিত্র বিধ্বংসী সিনেমার পোস্টার জনসমক্ষে সাঁটা যাবে না। অন্যথায় ধার্মিক লোকদের মনে পুলিশের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হবে। ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। এতে অন্যায়-অপরাধপ্রবণত বেড়ে যাবে। রাজস্বের অজুহাতে বিদেশ থেকে মদ আমদানি করা এবং দেশে মাদক ও জুয়ার অনুমতি সরকার দিতে পারে না এবং অযোগ্যকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিতে পারে না।

এক হাদীসে রয়েছে, ‘আল্লাহ্ তাআলা যাকে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত করেছেন, সে যদি জনগণের অকল্যাণ করে মারা যায়, তবে আল্লাহ্ তাআলা তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন। বর্ণনান্তরে রয়েছে, যে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৭১৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৩৮০) আরেক হাদীসে রয়েছে, যে শাসক নিজের জন্য যেমন কল্যাণচিন্তায় বিভোর, তেমন কল্যাণের চিন্তা যদি জনগণ ও দেশের জন্য না করে, তবে সে তাদের সঙ্গে বেহেশতে যেতে পারবে না। যে প্রশাসন অধিকতর যোগ্য লোক বাদ দিয়ে অন্যকে নিয়োগ দান করে, সে আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মুসলিম জনগণের খেয়ানত (বিশ^াসঘাতকতা ও বেইমানি) করল। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭০২৩)

শাসিতের দায়িত্ব: শাসিত জনগণের দায়িত্ব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা, তাদের কল্যাণ কামনা করা, জনকল্যাণমূলক কাজে তাদের সমর্থন করা। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- হিতাকাক্সিক্ষতাই দ্বীন (ইসলাম)। (বিখ্যাত সাহাবী তামীম দারী রা. বলেন) আমরা বললাম, (ইয়া রাসূলাল্লাহ্!) কার জন্য হিতাকাক্সিক্ষতা? তিনি বললেন-আল্লাহ্, তাঁর কিতাব (কুরআন), রাসূল, মুসলিম শাসকবর্গ ও মুসলিম জনসাধারণের জন্য।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৫) হাদীস প্রতীয়মান করে যে, শাসকবর্গ যদি শরীয়ত বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে না জড়ায়, তবে তাদের কল্যাণ কামনা করা সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলÑসবার জন্য অপরিহার্য, অন্যথায় তারা গুনাহগার হবে। রাজনৈতিক পলিসি ও সংস্কৃতি অনুসারে বর্তমান যেভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে সমালোচনা করা হয়, ইসলামী শরীয়ত তা অনুমোদন করে না। তবে সরকার যদি রাষ্ট্র ও জনস্বার্থ বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তা সরকার ও বিরোধী সকল দলের জন্য তার সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা জরুরি। এক্ষেত্রে অন্যদের তো দূরের কথা, সরকার দলীয় লোকদেরও চুপ থাকার সুযোগ নেই।

মুক্তির একমাত্র পথ: অন্যায় ও পাপাচারের পথ ছাড়তে হবে। সুদি কার্যক্রম ছেড়ে ইসলামি অর্থনীতির ছায়াতলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। তবেই কেবল বিশ^জুড়ে শান্তির সুশীতল সমীরণ প্রবাহিত হবে এবং অর্থনীতির স্থায়ী ও গতিশীল চাকা সঠিকভাবে ঘুরতে থাকবে। কুরআনি এই ফর্মুলা যতদিন শিকড়িত থাকবে, ততদিন মন্দা দেখা দেবে না এবং উন্নয়ন, জিডিপি ও প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে (তরজমা) ‘তোমরা নিজ পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন আর তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান এবং তোমাদের জন্য নদ-নদীর ব্যবস্থা করে দিবেন।’ (সূরা নূহ, ৭১ : ১০-১২) ‘যদি সেসব জনবাসী ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও জমিন থেকে কল্যাণ ও বরকতের দরজা খুলে দিতাম।’ (সূরা আরাফ, ৭ : ৯৬)

লেখক : শিক্ষাসচিব, জামিআ মুহাম্মাদিয়া ইসলামিয়া টিএন্ডটি মাদরাসা, বনানী, ঢাকা-১২১৩

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন