লেখাটি শুরু করছি একটি সত্য ঘটনা দিয়ে। শিশু ওয়ার্ডে একটি আট মাসের বাচ্চা ঠান্ডা, কাশি আর ঠিকমত না বাড়া সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়। আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল ওর শরীরে রক্তাল্পতা আছে। সব পরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়ে ‘থ্যালাসেমিয়া’। বাচ্চার বাবাকে আমরা সময় নিয়ে অসুখটি সম্পর্কে এবং এর চিকিৎসা বুঝিয়ে বললাম। তিনি অর্থনৈতিক ভাবে আগে থেকেই চাপে ছিলেন। সব শুনে মাথা ঘুরিয়ে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলেন। ‘থ্যালাসেমিয়া’ নামটিই তার জন্য ছিল অচেনা এক আঘাত।
থ্যালাসেমিয়া রোগটি সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক তথ্য জানা দরকার। আমাদের রক্তে তিন ধরনের রক্তকণিকার অন্যতম লোহিত রক্তকণিকা। এর প্রধান কাজ কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়া, আর দূষিত কার্বনডাইঅক্সাইড বের করার জন্য ফুসফুসে নিয়ে আসা। একেকটি কণিকার নির্দিষ্ট আয়ু (গড়ে ১২০ দিন) আছে। থ্যালাসেমিয়া রোগে অসুস্থ লোহিত কণিকা সময়ের আগে ভেঙে যায়, অর্থাৎ ১০০ দিনের আগেই তা ভেঙে যায়। শরীরে দেখা যায় রক্তাল্পতাসহ বিভিন্ন জটিলতা। রক্ত কমে বাচ্চারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়, রক্ত কনিকা ভেঙে বিলিরুবিন বেড়ে গিয়ে চোখ হতে থাকে হলদে, কপালের হাড় সহ অনেক স্থান থেকে রক্ত তৈরীর চেস্টায় কপাল উঁচু হতে থাকে, মাড়ির দাঁত এলোমেলো হয়ে যায়। এরা লম্বায়ও বাড়ে কম। ঘনঘন অসুখ লেগে থাকে। পেটে চাকার মত হয় (প্লীহা, যকৃত বড় হয়)। আবার বেশী বেশী রক্তকণিকা ভাঙলে ভিতরের লৌহ রক্তে এসে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে (মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, যকৃত, থাইরয়েড গ্রন্থি প্রভৃতি) জমে এগুলোকে অকার্যকর করতে থাকে।
এই রোগে ডিএনএ মিউটেশনের কারনে জন্ম থেকেই অস্থিমজ্জা থেকে অসুস্থ হিমোগ্লোবিন সহ লোহিত কনিকা তৈরী হয়। যার জীবন কাল খুবই কম। তাই এ রোগের প্রধান চিকিৎসা ‘অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন’। অর্থাৎ রুগীর হাড়ের অসুস্থ অস্থিমজ্জা বদলে ফেলে সুস্থ মানুষের অস্থিমজ্জা স্থাপন করা। এটি ব্যয়বহুল, অস্থিমজ্জা পাওয়া দুরূহ, গ্রহিতার শরীরে মজ্জা প্রতিস্থাপন ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি এবং প্রতিস্থাপন কেন্দ্রের অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে সরকারী ও বেসরকারী কয়েকটি হাসপাতালে এটি এখন হচ্ছে। তারপরও আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগীই এখনও বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বেছে নেয় আদিকালের চিকিৎসা ব্যবস্থা। অর্থাৎ রক্ত কমে গেলে রক্ত নেওয়া। এর সাথে রক্ত কিছুটা বাড়ার মুখের ওষুধ এবং রক্তে অতিরিক্ত লৌহ বের করার ওষুধের কথা অনেক রোগী জানেই না। যদিও এসব ওষুধে কিছু গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, তবু এগুলোর ব্যবহারে রোগীর জীবনকাল বাড়তে দেখা গেছে। সবমিলিয়ে প্রচলিত এই চিকিৎসা ব্যবস্থা আপৎকালীন জীবন বাঁচালেও ‘আদর্শ’ বলার সুযোগ নেই।
আমাদের তাই জোর দিতে হবে রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে। সাধারণত রক্তসম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে একই পরিবারের অল্প অল্প অসুস্থ বাবা-মা অর্থাৎ বাহকরা পরবর্তীতে থ্যালাসেমিয়াসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত বাচ্চার জন্ম দেয়। এই তথ্যটি সমাজে অনেকের অজানা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের আগেই থ্যালাসেমিয়ার ‘বাহক’ নির্ণয়। থ্যালাসেমিয়া রোগটির ‘ত্রুটি’ আমাদের কোষের জীনে সংরক্ষিত থাকে এবং বংশানুক্রমে পরিবাহিত হয়। এই ‘ত্রুটি’ যখন গুরুতর হয় তখন রোগটি প্রকাশ পায়। আর লঘু ত্রুটি থাকলে তেমন কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। হয়ত পরীক্ষায় সামান্য রক্তাল্পতা ধরা পড়তে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, লক্ষণ না থাকলেও, রোগী না হলেও, তিনি রোগের ‘বাহক’। এখন একজন ‘বাহক’ তার মত আরেকজন ‘বাহক’কে বিয়ে করলে আগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে। অথচ একজন ‘বাহক’ যদি বিয়ের আগে জেনে নেন তার সম্ভাব্য সঙ্গী ‘বাহক’ কিনা, আর তিনি যদি ‘বাহক’ বিয়ে না করেন, তাহলে সন্তানদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। অবশ্য অভিভাবক ‘বাহক’ না হলেও জীন মিউটেশনের মাধ্যমে খুবই কম সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া রোগ কিংবা বাহক নির্ণয়ের পরীক্ষার নাম ‘হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস’। এখনো সরকারিভাবে এই পরীক্ষার অপ্রতুলতা রয়ে গেছে। এই সুযোগে বেসরকারিভাবে অধিক মূল্যে এটি করতে হয়। জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারের উচিত সরকারিভাবে কম মূল্যে পরীক্ষাটির ব্যবস্থা করা।
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিয়ের আগে ‘হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস’ পরীক্ষাটি করার। পৃথিবীর অনেক দেশে এটা বাধ্যতামূলক। মিডিয়ায় থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে আরও প্রচার বাড়াতে হবে। আর সবচেয়ে জরুরি পাঠ্যপুস্তকে থ্যালাসেমিয়া’র অন্তর্ভুক্তি। সচেতন না করলে কেউ নিজের ইচ্ছায় পরীক্ষা করতে রাজি হয় না।
লেখাটি শেষ করছি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়া সেই বাবার একটি প্রশ্ন দিয়ে। ‘স্যার, এই রোগটা যখন এতই খারাপ, আপনাদের ওয়ার্ডে এত এত বাচ্চা কয়দিন পরপর মোটা সূচে চামড়া ফুটো করে রক্ত নিতে আসে, সরকার কেন এই রোগ সম্বন্ধে আমাদের জানায় না? আমি জানলে বিয়ের আগে পরীক্ষা করে দেখতাম রক্তে সমস্যা আছে কিনা’। আমাদের তাই সচেতনতা বাড়াতেই হবে। পাঠ্যপুস্তকে পাল, সেন, মুঘল শাসন শেখানোর চেয়ে জরুরি থ্যালাসেমিয়ার মত রোগগুলোর ব্যাপারে পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন করে তোলা।
ডা. আহাদ আদনান
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ,
শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, মাতুয়াইল, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৩১৬৯৮১৫৬৭।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন