বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসংখ্যা ১৯৩টি। আর প্রচলিত ধর্মের সংখ্যা ৪ হাজার তিনশটি। ধর্ম অনুসারীর সংখ্যা বিবেচনায় বর্তমানে পৃথিবীর প্রধান ধর্ম ৭টি। বিশ্বজনসংখ্যা রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা প্রায় আটশ কোটি। এ আটশ কোটি মানুষের মধ্যে খ্রিস্টানের সংখ্যা প্রায় ২৫০ কোটি। খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংখ্যা ১২৬টি। মুসলিমের সংখ্যা ২০০ কোটি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংখ্যা ৫৭টি। হিন্দুর সংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ৩টি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ কোটি। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংখ্যা ১০টি। ধর্ম অনুসরণের দিক দিয়ে হানজু বা হান সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। এদের বসবাস চীনে। অনুসারী বিবেচনায় পৃথিবীর ষষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম শিখ। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৩ কোটি মানুষ এ ধর্মে বিশ্বাস করে। অনুসারী বিবেচনায় পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ ধর্ম হলো ইহুদী। বিশ্বময় ইহুদী ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ১ থেকে দেড় কোটি। এর মধ্যে ৫৪ লাখ ইহুদী বসবাস করে ইসরাইলে। অবশিষ্ট ইহুদীর মধ্যে অনুমানিক ৬৮ লাখ বসবাস করে আমেরিকাতে। কানাডাতে বসবাস করে প্রায় ৩ লাখ। আর ইংল্যান্ডে বসবাস করে প্রায় ২ লাখ। সার্বিক দৃষ্টিকোণে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হলো আমেরিকা। আমেরিকার মোট জনসসংখ্যার ২% (দুই শতাংশ) হলো ইহুদী জাতি। আর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক দুই শতাংশ নাগরিক হলো ইহুদী। অর্থাৎ মোট ৫০০ জন মানুষের মধ্যে ইহুদী সংখ্যা হলো মাত্র ১ জন। কিন্তু বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোটা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিচ্ছে এ ইহুদীরা। আমেরিকার রাজনীতিতে ইহুদীদের প্রভাব একচেটিয়া। আশ্চার্যের ব্যাপার হলো, সংখ্যায় অতি নগন্য এ জাতির সমর্থন ছাড়া আমেরিকার কেউই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারে না! আবার তাদের সমর্থন ছাড়া কেউ প্রেসিডেন্ট থাকতেও পারে না! ইহুদী জাতিকে প্রাধান্যে রেখেই আমেরিকার রাজনীতি পরিচালিত হয়। ইহুদীদের তোয়াজ না করলে আমেরিকানরা চলতে পারে না। এ কারণে প্রতিটি আমেরিকান প্রশাসন ইহুদীদের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। আমেরিকান প্রশাসন ইহুদীদের সাথে সার্বক্ষণিক লবিং মেইনটেইন করে চলে। আমেরিকার সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করে সেদেশের কর্পোরেট হাউজগুলো। কর্পোরেট হাউজ হলো বড় বড় ব্যবসায়ী কোম্পানি। কর্পোরেট এ হাউজগুলো একজন প্রেসিডেন্টকে ইচ্ছামত উঠাতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে বসাতেও পারে। এসব কর্পোরেট হাউজের মূলদায়িত্ব পালন করে ইহুদী কমিউনিটির মানুষ। আমেরিকার নির্বাচনে ফান্ড গ্রহণ একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের সবচেয়ে বড়ো নির্বাচনী ফান্ড দাতা হচ্ছে ‘আমেরিকা-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি’, যা পরিচালিত হয় ইহুদী ব্যবসায়ীদের দ্বারা। আমেরিকার ১০০ জন সিনেটরের মধ্যে ১৩ জন হলো ইহুদী। আমেরিকার সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের মালিকানা ইহুদীদের হাতে। সকল আর্থিক কারবারের প্রযুক্তির বাটন ইহুদীদের কব্জায়। আমেরিকার অর্থনৈতিক, আর্থসমাজিক ও রাজনৈতিক সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন রয়েছে ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা। তার মানে, আমেরিকা ইচ্ছেমত দেশের বাজেট প্রণয়ন করতে পারে না। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় ইহুদীদের উপর।
আমেরিকার প্রায় সকল মিডিয়াই নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদীরা। বিশ্বখ্যাত সিএনএন, এবিসি, কার্টুন চ্যানেল, নিউ লাইন সিনেমা, ফক্স নেটওয়ার্ক, ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, স্পোর্টস চ্যানেল, ইএসপিএনসহ অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক ইহুদীরাই। আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইম, নিউইয়র্ক পোস্ট ও ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিখ্যাত পত্রিকাগুলো তাদেরই নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। বিশ্বময় পরিচিত ও সোস্যাল মিডিয়াখ্যাত ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ একজন ইহুদী। বিশ্বখ্যাত মিডিয়া মোঘল কিথ রুপার্ট মারডক একজন অস্ট্রেলিয়-আমেরিকান ইহুদী। তিনি বহুজাতিক সংবাদ মাধ্যমের নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নিউইয়র্কভিত্তিক ‘দি নিউজ কর্পোরেশন’-এর অধিকাংশ শেয়ারের মালিক। শুধু তাই নয়, বরং তিনি এ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পৃথিবীর সেরা ১৮৫টি পত্রিকার মালিক এই রুপার্ট মারডক। এছাড়া অসংখ্য টিভি চ্যানেলের জনক ও নিয়ন্ত্রক এই ইহুদী। মিডিয়া জগতের ৭০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে তার প্রতিষ্ঠিত ‘দি নিউজ কর্পোরেশন!’ প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের উপর পরিচালিত যে কোনো হামলাকে বৈধতা দিতে তার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে আমেরিকার হামলাকে সাধারণ আমেরিকানদের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য করতে তার নিয়ন্ত্রিত ‘ফক্স নিউজ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
আমেরিকার পত্রিকাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী পত্রিকার নাম হলো নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ওয়াশিংটন পোস্ট। বিখ্যাত এ তিনটি পত্রিকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইহুদীদের হাতে। এসব পত্রিকা যে কোনো সময় আমেরিকার সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। এর জ¦লন্ত উদাহরণ হলো ওয়াটারগেট কেলেংকারীর জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগ। ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বাণিজ্যিক ভবনের নাম হলো ‘ওয়াটার গেইট’। এ ভবনটি ছিল ডেমোক্রেটদের প্রধান কার্যালয়। আর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ছিলেন রিপাবলিকান দলের পদপ্রার্থী। নিক্সন তখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ডেমোক্রেটদের নির্বাচনী কৌশল জানতে ১৭ জুন ১৯৭২ সালে নিক্সনের ৫ জন গোয়েন্দা উক্ত ভবনে প্রবেশ করে। ভবনের ভিতর কিছু টেপ রেকোর্ডার রেখে আসে, যা দ্বারা কথাবার্তা রেকর্ড করা যায়। এটাকে আড়িপাতা অপরাধ হিসেবে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ব্যাপক প্রচার করে, যা রিপাবলিকান দল ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ফলে নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়। এ পদত্যাগের পেছনে বড়ো ভূমিকা রেখেছিল ওয়াশিংটন পোস্ট। বর্তমানে এর পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করছে ইহুদীদের তৃতীয় প্রজন্মখ্যাত ডোনাল্ড গ্রেহাম। পত্রিকাটির অধীনে আরো অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে শুধু আর্মীদের জন্যই প্রকাশিত হয় ১১টি পত্রিকা। এ পত্রিকার অধীনে আরেকটি পত্রিকার নাম হলো ‘সাপ্তাহিক নিউজ উইক’। বিশ্বজুড়ে সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটির ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। আমেরিকার রাজনৈতিক জগতের প্রভাবশালী পত্রিকার নাম হলো ‘নিউইয়র্ক টাইমস’। যুগ যুগ ধরে এর প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছে ইহুদীরা। বর্তমানে এর প্রকাশক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে আর্থার সালজবার্গার। আর প্রেসিডেন্ট সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে রাসেল টি লুইস, আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে মাইকেল গোল্ডেন। এসকল দায়িত্বরত ব্যাক্তিবর্গ ইহুদী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকাতে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা বিক্রি হয় প্রায় ১০ কোটি কপি। এসব পত্রিকা নিউজ সার্ভিসের জন্য সাহায্য নেয় সাধারণত (এপি) তথা এসোসিয়েটেড প্রেস থেকে। শুধু আমেরিকার উল্লেখিত পত্রিকাগুলোই নয়, বিশ্বের অধিকাংশ পত্রিকা নিউজ সার্ভিস পেতে উল্লেখিত এসোসিয়েটেড প্রেসের সাহায্য নিয়ে থাকে। এই এসোসিয়েটেড প্রেসের মালিক একজন ইহুদী। এর ম্যানেজিং এডিটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হলো মাইকেল সিলভারম্যান। প্রতিদিন কী নিউজ প্রকাশ করতে হবে, আর কী করতে হবে না, সেটা তিনিই ঠিক করেন। বিশ্বের অর্থনীতির একক ও অদ্বিতীয় নিয়স্ত্রক হলো আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। প্রতিদিন ১৮ লাখের বেশি এটি বিতরণ হয়। পত্রিকাটির প্রকাশক ও চেয়ারম্যান হলো পিটার আর কান, যিনি ৩৩টিরও বেশি পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজার। আর শুধু আমেরিকাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬ হাজার। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এককভাবে ইহুদী ছাত্র সংখ্যা ২০ শতাংশর বেশি। আমেরিকার নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে এককভাবে ইহুদীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ। তার মানে, প্রতি ৪ জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে একজন ইহুদী। আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার সব কজন ভাইস চ্যান্সেলর ইহুদী সম্প্রদায়ভুক্ত। এছাড়া আমেরিকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগণ ইহুদী সম্প্রদায়ের। মুসলিম দেশগুলোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্ব র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি। সেখানে এক আমেরিকাতে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিয়েছে ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রথম ১০টির মধ্যে এককভাবে সাতটিই আমেরিকার।
পৃৃথিবীর এমন কোনো দেশ নাই যেখানে নামে বা বেনামে ইহুদীদের কর্মকান্ড নাই। এরা পৃথিবীর অতিশয় ক্ষুদ্র একটি জাতি। অথচ, এ জাতিটি শুধু তাদের বুদ্ধিমত্তার জোরে সারা পৃথিবীকে শাসন ও শোষণ করে চলেছে। বিশ্বময় তারা এমন এক বলয় গড়ে তুলেছে যে, তাদের এ বলয় থেকে কারো বের হবার কোনো উপায় নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, মিডিয়া- সকল দিক ও বিভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। ব্লাড ক্যান্সারের মতো পৃথিবীর রক্তনালীতে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দুনিয়ার সকল সংঘাতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নাটের গুরু এই ইহুদী জাতি।
একজন ইহুদী সন্তান জন্ম নেবার সাথে সাথেই তাকে শেখানো হয় মুসলিমরাই তাদের শত্রু। তাদের বুঝানো হয়, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশল দিয়েই তাদেরকে টিকে থাকতে হবে। এ কারণে অনেক ইহুদী জ্ঞানী থেকে মহাজ্ঞানী ও আবিষ্কারকের যোগ্যতা অর্জন করছে। বর্তমান পৃথিবীকে কব্জা করতে সব ধরনের প্রযুক্তিগত জ্ঞান তারা অর্জন করেছে। আজ গোটা পৃথিবী অনলাইনের জালের আওতায় একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ইহুদীদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি। এর বাইরে বিকল্প ভাবার কোনো সুযোগই এখন আর অবশিষ্ট নাই। ইহুদীদের আবিষ্কৃত জ্ঞান থেকে অন্যরা অল্প কিছু আয়ত্ব করে আস্ফালন দেখাচ্ছে। অথচ, ইহুদীরা জ্ঞানের নতুন শাখার সংযোজনে মহা ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের গর্ব আর আস্ফালনের বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই। মুসলিমরা এ জাতীয় যোগ্যতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। তাদের গন্ডির চৌহদ্দি অত্যন্ত সীমিত। একদা এই মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তারাই এখন পদে পদে মার খাচ্ছে, অপদস্ত হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! কবে মুসলিমরা জাগ্রহ হবে?
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা‘ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন