গল্পের শেয়াল, পথে বাঁশ বেঁধে বনের নিরীহ পশুর যাতায়াতের সমস্যা সৃষ্টি করে চুপচাপ ঝোঁপের মাঝে লুকিয়েছিল। নিরীহ, দুর্বল বন্যপশুরা তাদের চলার পথের সংকট সমাধানে পরিত্রাতার অন্বেষণে ব্যতিব্যস্ত দেখে ধূর্ত সেই শেয়াল বন থেকে বেরিয়ে এসে বলল: কী ভাই! তোমাদের সমস্যা কী? শান্তশিষ্ট জীবগণ তাদের যাতায়াতের সমস্যার কথা বলার পর শেয়াল বলল: এটা আমার দাদার চালাকি। দাদা কারও উপকার করতে এগিয়ে আসে না, শুধু সমস্যা সৃষ্টি করে রাখে। তোমরা যদি আমার একটা কথা রাখ তাহলে আমি এখনই তোমাদের সমস্যা দূর করে দেব। নিরীহ পশুর দল কথা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ধূর্তরাজ বলল: অচিরে এ বনের রাজ নির্বাচনে এক বড় সভা বসবে। আমি এবং আমার দাদা রাজার আসনপ্রার্থী। তোমরা সে সভায় আমার পক্ষে ভোট দেবে। আমি রাজা হলে তোমাদের কোনও সমস্যা থাকবে না। দুর্বল জন্তুরা এতে রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেয়াল তার চেলাচামুন্ডাদের ডেকে এনে পথের বাঁশ সরিয়ে দিল। পশুর দল ‘জয় ছোট শেয়ালের জয়’ বলতে বলতে ঘাসের মাঠে চলে গেল।
এদিকে ছোট শেয়ালের বড় ভাই আড়ালে বসে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল। তৃণভোজী পশুর দল ও ছোট শেয়াল চলে যাওয়ার পর সে বাঁশটি আবার পথের মাঝে বেঁধে রেখে ঘাসের বন থেকে পশুদের ফেরার অপেক্ষায় চুপ করে বনে লুকিয়ে রইল।
আমাদের এ দেশের চিরস্থায়ী বিদ্যুৎ যন্ত্রণার কথা ভাবলে গল্পের ছোট শেয়াল ও বড় শেয়ালের সমস্যা সৃষ্টির কাহিনীটা মনে আসে। জনজীবনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে গেলে বোধহয় জনতার দুঃখ মোচনে রাজনৈতিক অভিনয় ভালো হয় না। সম্ভবত এ কারণেই বিদ্যুৎ সংকট সমাধান না করে বিভিন্ন উপলক্ষে যা বলা হচ্ছে তা অবুঝ শিশুদের বুঝ দেয়ার সঙ্গেই তুলনীয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মনিপুর রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ভিন্ন রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে বলে পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের মতো দেশে তার ঘরের আলো জ্বালাবার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। আমাদের দেশ কি প্রাকৃতিক সম্পদে এতই দরিদ্র? দেশের অকথ্য বিদ্যুৎ সংকটে গ্রাহকদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও নানাবিধ আর্থিক ক্ষতির বিস্তৃত বিবরণ এখানে নিষপ্রয়োজন। স্কুলের একটা শিশুরও এ যন্ত্রণা ও ক্ষতির অভিজ্ঞতা আছে। যথোচিত পরিষেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে মাশুল আদায় করে যেভাবে তাদের মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর ন্যায্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করে অকথ্য যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ করছে, তাতে গ্রাহক সুরক্ষা আইনে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার লক্ষ্যে মামলাও বোধহয় দায়ের করা যায়। মানুষকে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ করা কেবল মাত্র মগের মুল্লকেই বোধ হয় সম্ভব।
নিয়ম-নীতি ও বিজ্ঞপ্তিহীন স্বেচ্ছাচারী লোডশেডিংয়ের জ্বালা, হঠাৎ আলো নিভিয়ে মানুষকে বিব্রত, হতভম্ভ ও অনড় পুতুল বানিয়ে রাখা কিংবা অন্ধকারে হাতড়ানো অবস্থায় কোনও দুর্ঘটনার মুখে ঠেলে দেয়া, আলো এবং অন্ধকারের ঘন ঘন আবির্ভাব ও তিরোভাবের ভেল্কিবাজিতে মানুষের যন্ত্রণার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া, গ্রাহকদের ঘাড়ে মোম-ম্যাচ-কেরোসিন-টর্চ-টর্চের ব্যাটারি-ইনভার্টারের অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপানো ইত্যাদি অবাঞ্ছিত কর্মে বিদ্যুৎ বিভাগ দেশের এক স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচারী রাজার মতোই বিদ্যুৎরাজা। এ স্বেচ্ছাচারী রাজার অত্যাচারে ছাত্রছাত্রীদের রাতের পড়াশোনা বন্ধ হয়, অন্ধকারে মশা ও গরমের দাপটে মানুষ অস্থির, অসুস্থ হয়, ঘরের গৃহিণীদের রাতের স্বাভাবিক ও জরুরি গৃহকর্ম ব্যাহত হয়, নিয়মানুসারে বাসায় রোগীর শুশ্রুষা এবং চিকিৎসার ও ব্যাঘাত ঘটে। এদিকে ঢাকায় জ্বালানি সংরক্ষণ ও চাহিদা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক সেমিনারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিকেল ৫টার পর দোকান ও শিল্প উৎপাদন বন্ধ, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখা থেকে বিরত থাকা, এনার্জি সেভিংস বাল্ব ব্যবহার ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পালাক্রমে বিপণি বিতানে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরামর্শ দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরামর্শ কি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের স্বার্থের অনুকূলে? দিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি নিরসনে টিভির পর্দায় একটু চিত্তবিনোদন কালে স্বেচ্ছাচারী বিদ্যুৎরাজা আলোর সুইচ অফ করে চিত্তবিনোদনের বদলে মানুষের চিত্তবিকার সৃষ্টি করে। এক কথায়, মানুষের পকেট শূন্য করে বিদ্যুৎ বিভাগ যথোচিত পরিষেবার বদলে দিচ্ছে লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণা। বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন, তার, খুঁটি ইত্যাদি পরিকাঠামোর সংরক্ষণে যথোচিত নজরদারির অভাবে এবং এসব পরিকাঠামোতে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অদক্ষতায় সামান্য ঝড়বৃষ্টিতেই বিদ্যুতের লাইন, তার, খুঁটি ইত্যাদি লন্ডভন্ড হয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ দীর্ঘকাল বন্ধ থাকে এবং এর সাথে পানীয় জল সরবরাহও বন্ধ হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের এসব অবাঞ্ছিত কর্মের ফল ভোগ করে গ্রাহকরা।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেশের চাহিদার তুলনায় কম এবং অর্থ ও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে ভিন্ন স্থান থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না বলেই দেশের বিদ্যুৎ সংকট দূর করা যাচ্ছে না, এমন কথা বলা হয়ে থাকে সরকারের পক্ষ থেকে। এ কথা দেশবাসী দীর্ঘকাল ধরেই শুনে আসছে। বড় বড় কেলেংকারিতে লিপ্ত রাজপুরুষদের রাজভান্ডারে টাকার অভাব ঘটতেই পারে, তদুপরি বিভাগীয় চুরি ও দুর্নীতি থাকলে বিদ্যুৎ কেনা তো দূরের কথা, নিত্য প্রয়োজনীয় গামছা কেনার পয়সারও একদিন অভাব ঘটতে পারে। তবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুবিধা আছে, সে সম্পদ কাজে লাগানোর বুদ্ধি, সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকলে ঘরের বিদ্যুৎ দিয়েই ঘর আলোকিত করা যায়। উৎপাদক সৎ, দক্ষ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও উদ্যোগী হলে চাহিদা অনুসারে উৎপাদন করে মুনাফার মুখও দেখতে পারে। কিন্তু ওরা যদি উদ্যোগহীন অলস, অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ হয় তাহলে মূলধনই বারোভূতে লুটেপুটে খাবে। এ ভূতের দলের বিদ্যুৎ চুরির হিড়িক এ দেশে ব্যাপক। এতে বিদ্যুৎ বিভাগ সত্যই ক্ষতিগ্রস্ত। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রশাসককূলের সততা ও দক্ষতা থাকলে এ চুরিও বন্ধ করা যায়। বিভাগের শ্বেতহস্তীসম বৃহদাকার প্রশাসককূল থাকতে চোখের সামনে এ চুরি হচ্ছে কেন?
লোকে বলে, চোর ধরে চুরি বন্ধ করার সাহস ও মানসিকতা চোরের থাকে না। তাই চুরি ও চোরের সহযোগী দুর্নীতির জন্যে বিদ্যুৎ বিভাগ ঋণগ্রস্ত হওয়ায় তার উৎপাদনের উদ্যোগও নেই। আর এ উদ্যোগহীনতার জন্যেই বিস্ময়কর বিদ্যুৎ যন্ত্রণা লাগাতার চলছে। সুতরাং বিদ্যুতের অভাবটা মানুষের দুর্নীতি ও অদক্ষতাসৃষ্ট অভাব। তাদের আন্তরিকতা উদ্যোগ দেশ ও জাতিপ্রেম থাকলে এমন হতো না। যেখানে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেখানে দেশের জনগণ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অফিস-আদালত, কলকারখানা এমনকি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অপারেশন পর্যন্ত বিদ্যুতের অভাবে বিঘ্নিত, যেখানে প্রতিদিন হাজার মেঘাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি, সেখানে আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের পরিবার পরিজন নিয়ে নৌবিহারে যাওয়ার নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।
ক’বছর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল তা থেকে বিদ্যুৎ কবে উৎপাদিত হবে, কবে অন্ধকার সরে আলো জ্বলবে তার কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না সরকার বা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, সেসব গড়ে উঠলে আজ মারাত্মক বিদ্যুৎ যন্ত্রণা ঘটার কথা ছিল না। সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের তুঘলকি কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, নেতা-মন্ত্রী-মন্ত্রণালয়-প্রশাসন কেউই বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের চেয়ে সমস্যা সৃষ্টিই যেন তাদের প্রধান উপজীব্য বিষয়। ইচ্ছা করে সমস্যা সৃষ্টি করলে সে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই সমস্যা সৃষ্টির রাজনীতি ছেড়ে পূর্বসূরীদের গালাগালি বন্ধ করে আজ সমস্যা সমাধানের সুস্থ রাজনীতিই চালু করতে হবে।
লম্বা লম্বা কথা না বলে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে আজ বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে সরকারের। জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ছোট ছোট নদীর অভাব নেই। অভাব প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাবার আন্তরিক উদ্যোগ ও সদিচ্ছার। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে, অভাব, অভাব বলে চিৎকার করার জন্য আমরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি না। ‘অভাব’ নামক অজুহাতে দায়িত্ব এড়াবার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের বিশাল প্রশাসন পোষা হচ্ছে না। জননেতা ও প্রশাসনের নিযুক্তি জনতার অভাব ও যন্ত্রণা লাঘবের জন্য। তাদের এ জ্ঞান যদি তারা হারিয়ে ফেলেন তাহলে সকল মানুষকে সক্রিয় হতে হবে তাদের লুপ্ত জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য। জনতার পক্ষে এ কাজ সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন