শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবি আন্দোলনে গত ১৬ জানুয়ারি এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করে রাখলে সেখানে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হলে প্রভোস্ট পদত্যাগের দাবি আন্দোলন ভিসি বিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। ভিসির পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে অনশনে বসেন ২৭ শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল দম্পতির ‘সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের’ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়া হবে এমন আশ্বাসে ১৬৩ ঘন্টা পর অনশন ভাঙেন তারা। এছাড়া ‘সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের ওপর দায়ের করা মামলা তুলে নেয়া হবে এবং শিক্ষার্থীদেরকে একাডেমিকভাবে কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না’ শিক্ষামন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পর পেরিয়ে গেছে ৮ মাস। এখনও তাদের প্রধান দাবিসহ অধিকাংশ দাবি বাস্তবায়ন না হলেও আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও ক্লাসের বাইরে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা।
রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিন দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া সজল কুন্ডুর সাথে সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল বাশার রাজ এ অভিযোগ তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা শাহরিন রশিদ ও শাহরিয়ার আবেদিন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সজল কুন্ডু, পরিসংখ্যান বিভাগের নওরিন জামান, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের হালিমা খানম ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রক্তিম সাদমানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এসময় ‘দাবি মেনে নেয়া হবে’ এমন আশ্বাসের পর প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেলেও মূল দাবি পূরণ না হওয়া এবং ‘এভাবে চলতে থাকলে’ পুনরায় কঠোর আন্দোলনে ফেরার হুশিয়ারি জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, “পুলিশি হামলার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সজল কুন্ডু। তার শরীরে ৮৩টি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। অস্ত্রোপাচারে ৮টি স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব হলেও এখনো তার শরীরে ৭৫টি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। আন্দোলনে সমর্থন করায় ও প্রশাসনের বিরোধিতার অভিযোগ এনে কৌশলগতভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এ ক্যাফেটেরিয়া। এর প্রেক্ষিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ‘শিক্ষার্থীদের নামে করা মামলা প্রত্যাহার, শিক্ষার্থীদের দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এবং অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া ক্যাফেটেরিয়া ফেরত দেয়া’ এ তিন দফা দাবিতে একক অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন সজল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সজলের দাবিগুলো মানার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয় নি। আমরা শাবিপ্রবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা সজলের দাবিগুলোর সাথে সম্পূর্ণভাবে সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করছি। তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্যায় করছে।”
রাজ আরও বলেন, “১৬ই জানুয়ারির হামলার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সজল কুন্ডুকে অন্তত ৯ম গ্রেডের একটি চাকরি এবং নগদ ক্ষতিপূরণ দেয়ার স্পষ্ট আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সজল এখনো শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ বা চাকরি কোনোটাই পাননি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি যে ক্যাফেটেরিয়াটি চালাতেন সেটিও কেড়ে নেয়া হয়েছে। এমনিতেই স্প্লিন্টার ও বোমার মারাত্মক ক্ষত নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেও হিমশিম খাওয়া সজলের একমাত্র কর্মসংস্থান কেড়ে নেয়ায় চরম অর্থ সংকট তার সামনে নতুন আতঙ্ক হয়ে ধরা দিয়েছে।” রাজ বলেন, “চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম কিছুদিন সরকারী তত্ত্বাবধানে সজলের নিয়মিত চেকআপের ব্যবস্থা করা হলেও গত তিনমাস ধরে তাও বন্ধ। বারবার এ ব্যাপারে অবহিত করার পরও সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারো তরফ থেকেই আর সজলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া হচ্ছে না।”
এছাড়াও “স্বল্প সময়ের মধ্যে মামলা তোলার কথা বলা হলেও ইতোমধ্যে ৮ মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো কোন মামলা তোলা হয় নি। তবে সাবেকদের অর্থ সরবরাহের প্রেক্ষিতে দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি একটি আপোষনামা আমাদের হাতে এসেছে। তবে অজ্ঞাতনামা মামলা সমাধানে এখনো কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান হয় নি” বলেও জানান তিনি।
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদেরকে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে রাজ আরও বলেন, “শিক্ষার্থীদের কোন ধরণের ক্ষতি হবে না এ শর্তে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষক বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মন জয় করে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে পেশাগত দায়িত্ব ভুলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করছেন। যেকোনো ইস্যুতে অযথা তাদেরকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে কোর্স সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আবার কখনো কখনো ক্লাসে পড়া না পারার অজুহাতে অপমানও করছেন। তাছাড়া এক শিক্ষার্থী থিসিস করতে চাইলে তার বিভাগের কোনো শিক্ষকই তার সুপারভাইজার হিসেবে তাকে নিতে চাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে পুলিশি হামলার সুষ্ঠু তদন্তের লক্ষ্যে গত ১৬ জানুয়ারি রাতে ভৌত বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ তালুকদারকে সভাপতি করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে আট মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত কমিটি এখনো দৃশ্যমান কোনো রির্পোট দিতে পারেনি বলে জানান রাজ। তবে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা বেশ কয়েকজন প্রতক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নিয়েছি। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমাদের কার্যক্রম চলছে। সম্পূর্ণ রিপোর্ট তৈরি করতে আমাদের আরো কিছুদিন সময় লাগবে।” তবে তদন্তের কাজে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায় নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন