দেশে সংঘাতের রাজনীতি ফিরে আসার আলামত দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি দল ও সরকারের ভূমিকা সব সময়ই প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা প্রধান বিরোধীদল বিএনপির কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীও পালন করতে দিচ্ছে না। যেখানে কর্মসূচী সেখানেই হামলা। হামলার পাশাপাশি অস্ত্রের মহড়া, গুলিবর্ষণ এমন কি লুটপাটও বাদ যাচ্ছে না। প্রত্যন্ত উপজেলা থেকে রাজধানী পর্যন্ত সর্বত্রই ক্ষমতাসীনদের এই বলদর্পী আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করছে পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য। তারাও আওয়ামী নেতাকর্মীদের মতো অনেক স্থানে হামলায় অংশ নিচ্ছে। মামলা দিচ্ছে ও গ্রেফতার করছে। গত শনিবার রাজধানী ঢাকা ও কুমিল্লায় আওয়ামী নেতাকর্মীদের হামলায় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা গুরুতর আহত হয়েছেন। ঢাকার বনানীতে ওইদিন বিএনপির মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও মৌন অবস্থান কর্মসূচী ছিল। কর্মসূচীতে বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মহিলা নেত্রী শিরিন সুলতানা, শামা ওবায়েদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল আহত হন। ওদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু ও তার স্ত্রী নোয়াখালীর গ্রামের বাড়ি থেকে আসার সময় কুমিল্লায় আক্রান্ত হন। এইসব শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতার প্রতি ন্যূনতম সৌজন্য প্রদর্শন করা হয়নি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, গত আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৮টি কর্মসূচীতে হামলা হয়েছে। ২৫টি স্থানে নেতাকর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। অনেক স্থানে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচীর স্থলে সরকারি দল বা সহযোগী সংগঠন কর্মসূচী ঘোষণা করায় প্রশাসনের তরফে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ওইসব স্থানে বিএনপি কর্মসূচী পালন করতে পারেনি। এরকম স্থানের সংখ্যা ১৭টি। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ বিভিন্ন ঘটনায় ৪৬টি মামলা করেছে, যার মধ্যে পুলিশ বাদী হয়েছে ২৯টিতে, বাকি ১৭টির বাদী আওয়ামী নেতাকর্মীরা। এসব মামলায় মোট আসামীর সংখ্যা ২১ হাজার ৭০৯। বিএনপির নেতাকর্মীরা মারও খেয়েছে, মামলার শিকারও হয়েছে। এখন অনেকে ঘরছাড়া, বাড়ি ছাড়া। এমতাবস্থায়, গত রোববার ঢাকার নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দলের তরফে যেখানে হামলা, সেখানে প্রতিরোধের ডাক দেয়া হয়েছে।
এক পক্ষের হামলা, অন্য পক্ষের প্রতিরোধ, অবস্থাটা তাহলে কী দাঁড়াতে পারে? সংঘাত-সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল, প্রাণহানি ইত্যাদি ছাড়া আর কী? এরকম রাজনৈতিক সংঘাত বা সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগেও দেখা গেছে। তাতে প্রাণ ক্ষয়, সম্পদনাশ, উৎপাদন ক্ষতি, শান্তি-স্থিতির হানি হয়েছে যথেষ্ট। এসব ক্ষয়ক্ষতি কারোই কাম্য হতে পারে না। এজন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা, পারস্পরিক সম্মান-শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসরণ অপরিহার্য। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উন্নয়ন-অগ্রগতিরও পূর্বশর্ত। গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তরান্বিত হয়েছে। এখন সেই স্থিতিশীলতার ব্যত্যয়-লঙ্ঘন দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠলে উন্নয়ন কাজ ব্যহত হতে বাধ্য। এদিকে দেশের সামগ্রিক অবস্থা মোটেই ভালো না। সামনের বছর নির্বাচন। অতীতে দুটি নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশ্ন ছিল। আগামী নির্বাচন যাতে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে ব্যাপারে দেশ-বিদেশের চাপ আছে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার অন্ত নেই। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং মানবাধিকারের উন্নয়ন অবশ্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। আগামীতে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের আশংকা। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতির ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ ঝুঁকি যথাযথভাবে মোকাবিলা করার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে যে কোনো ব্যর্থতা জীবনযাত্রা, উন্নয়ন, উৎপাদন ও অর্থাগমকে মারাত্মকভাবে ব্যহত ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বিশ্বপরিস্থিতির কারণে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ওপর আগের মতো ভরসা করার উপায় নেই। অর্থপাচার ও আমদানি বৃদ্ধিতে রিজার্ভের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সরকারের হাতে টাকা নেই। টাকার জন্য বিশ্বব্যাংক- আইএমএফ’র কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে। চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে নেয়াও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এ মুর্হূতে দেশের মানুষের খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সংস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের আয়-রোজগার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ও মানুষের জীবনযাপন সহজ ও মসৃণ করার জন্য ব্যাপক হারে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দরকার। এটা এই সময়ের প্রধান দাবিও বটে। উন্নয়ন প্রকল্প ও বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়ের সুযোগ মোটেই রাখা ঠিক হবে না। যথাসময়ে নির্ধারিত অর্থে তা শেষ করতে হবে। কাজ হতে হবে মানসম্পন্ন। নতুন নতুন প্রকল্প ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্তক হতে হবে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্পে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশজুড়ে একটা কর্মপ্রবাহ বা কর্মচাঞ্চল্য তৈরি করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি সর্বপ্রযত্নে নিশ্চিত করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সরকারকে এমন একটা রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলত হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করে। অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্বাধে ও স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে। রাজনৈতিক সংকটটা আসলে কোথায়, তা আমাদের কারো অজানা নেই। একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা নিশ্চিত হলে এ সংকট কেটে যাবে। সেদিকে নজর দিতে হবে সঙ্গতকারণেই। আমরা আশা করবো, রাজনীতি যাতে ফের সংঘাতের পথে যেতে না পারে, সরকার তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন