মাটির নিচে খনিতে পাওয়া এই গ্যাস বর্তমান সভ্যতার প্রধান চালিকা শক্তি। পরিবারের ছোট্ট পরিসর থেকে শুরু করে, যানবাহন এবং কলকারখানার বৃহৎ পরিসর- সর্বত্রই আজ গ্যাসের ব্যবহার বিদ্যমান। গ্যাসের সহজ লভ্যতা একটি দেশের শিল্পায়নকে যেমন ত্বরান্বিত করে, ঠিক তেমনি গ্যাসের স্বল্পতা একটি দেশের শিল্পায়নের বিকাশকে মন্থর করে। তাই দেশের অর্থনীতির বিকাশ এবং গ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠা এই অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে দেশে গ্যাসের সহজ লভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান ও গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে হবে।
পোশাক শিল্প, ডাইয়িং, ফিনিশিং, টেক্সটাইল মিল, স্পিনিং মিল, টাইলস ও সিরামিক মিল, রাইস মিল, কেমিক্যাল মিল, স্টিল মিল, ওয়েল রিফাইনারি, খাদ্য প্রস্তুতকারি বেকারিসহ প্রায় সকল ধরনের মিল কারখানায় গ্যাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যবহার বিদ্যমান। এসব মিল কারখানায় বেশ কিছু ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে, যেগুলো সরাসরি গ্যাস দ্বারা চালিত। ফলে গ্যাসের অভাবে এই সব মেশিনে উৎপাদন বন্ধ থাকলে পুরো কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। যেমন পোশাক শিল্প এবং ডাইয়িং, ফিনিশিং, টেক্সটাইল মিলে প্রয়োজনীয় স্টিম উৎপাদনের জন্য বয়লার চালাতে হয়। আর বর্তমানে প্রচলিত অধিকাংশ বয়লারই কিন্তু গ্যাস ভিত্তিক। সুতরাং গ্যাসের অভাবে স্টিম উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হয়। সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিংগুলো প্রত্যক্ষভাবেই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। এসব স্পিনিং মিল সাধারণত ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে এবং এসব মিল চালাতে কয়েক মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। আর বিদ্যুৎ গ্যাস জেনারেটরের মাধ্যমে কারখানাতেই উৎপাদিত হয়, যাকে আমরা ক্যাপটিভ পাওয়ার বলি। আমাদের দেশে স্পিনিং মিলের সংখ্যা চারশ’রও বেশি এবং এসব স্পিনিং মিলের প্রায় সবগুলিই ক্যাপটিভ পাওয়ারের সাহায্য চলে। গ্যাস সংকটের কারণে এসব স্পিনিং মিলগুলো সমস্যায় পড়েছে। গ্যাসের প্রেসার কম হলেও জেনারেটর চালানো যায় না, আবার গ্যাস না থাকলে তো কথাই নেই। ফলে জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না এবং কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। আর সুতা যেহেতু রপ্তানিযোগ্য পোশাকের প্রধান কাঁচামাল, তাই স্পিনিং মিলের সমস্যায় পুরো পোশাক খাতই সমস্যায় পড়ে। ফলে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। টাইলস ও সিরামিক মিল এবং বেকারি ফ্যাক্টরিতে ওভেনসমূহ গ্যাসেই চলে। এভাবে গ্যাস সংকটে প্রায় সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানই সমস্যায় পড়বে এবং সবক্ষেত্রেই উৎপাদন ব্যাহত হবে।
গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসমূহ ও যথারীতি সমস্যায় পড়বে। গ্যাস সংকটের কারণে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে না। ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমার কারণে লোডশেডিং করতে হবে, যা এখন চলছে। আর প্রতিটি শিল্পকারখানায় যেহেতু কোন না কোনভাবে বিদ্যুৎ লাগেই, সুতরাং বিদ্যুতের অভাবে সব ধরনের শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হবে। কলকারখানার পাশাপাশি বাংলাদেশে যানবাহনের বিরাট একটি অংশ গ্যাসের সাহায্যে চলাচল করে। আবাসিকের বিরাট একটি অংশও রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার করে। সরকার দীর্ঘদিন ধরেই আবাসিক এবং হোটেল রেস্তোরাঁয় গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে আবাসিক এবং হোটেল রেস্তোরাঁয় বিদ্যমান গ্যাস ব্যবহারকারীরাও সমস্যয় পড়ছে। গ্যাস সংকটের কারণে চুলায় সব সময় গ্যাস থাকে না। আবার গ্যাস থাকলেও গ্যাসের প্রেসার কম থাকে। ফলে সব সময় রান্না করা যায় না। নতুন বাসাভাড়ি এবং হোটেল রেস্তোরাঁয় লাইনের গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে সিলিন্ডার বেইজড এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৫টি কো¤পানি সিলিন্ডারে করে এলপি গ্যাস বাজারজাত করছে এবং আরো ৪টি কো¤পানি বাজারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন এবং সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল লাগাদ দেশে এলপি গ্যাসের গ্যাসের চাহিদা বছরে ২৫ লাখ টনে দাঁড়াবে। এই এলপি গ্যাসের শতকরা ৯৫% ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, বাকি ৫% দেশীয় উৎস থেকে যোগান দেয়া হয়।
তবে রান্নায় এলপি গ্যাস দিয়ে সমস্যার সমাধান করা গেলেও, কলকারখানার গ্যাসের চাহিদা কিন্তু লাইনের গ্যাস ছাড়া পূরণ হবে না। এর সমাধানে গ্যাসের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান এবং গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট, কিন্তু দেশে উত্তোলিত হয় ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এখানে চাহিদার তুলনায় যোগান দৈনিক ১৫০ কোটি ঘনফুট কম। ফলে গ্যাস সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আবার গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্যাসের এই ঘাটতি মেটাতে আমরা বিদেশ থেকে এলএনজি (লিকুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানি করছি। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে কোনো সমাধান নয়। দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস সংকটের সমাধান করতে হলে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে, আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে হবে এবং উত্তোলিত গ্যাস তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য পাইপ লাইন স্থাপন করতে হবে। এ জন্য সরকারকে স্পেশাল উদ্যোগ নিতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্যাস সেক্টরে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এবং সময়ে সময়ে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। বিভিন্ন সময়ের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে বাংলাদেশের মাটির নিচে এবং এদেশের সমুদ্র সীমায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস মজুদের আভাস পাওয়া গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ একটি ভাটির দেশ হওয়ায় এদেশের মাটির নিচে অধিক পরিমাণে গ্যাস মজুদ থাকার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ২৮টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে দেশের সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, আর ২০২১ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে সর্বশেষ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। ১৯৫৫ সালে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হবার পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই এদেশে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণে গ্যাস মজুদের সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে। সুতরাং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে বসে থাকলে চলবে না। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র হতে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা জাতীয় পাইপ লাইনে সংযুক্ত করতে হবে। যেমন বাংলাদেশের দ্বীপ জেলা ভোলায় একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলোর থেকে যথাযথ পরিমাণে গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে না। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র হতে দৈনিক ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ থাকলেও উত্তোলন করা হচ্ছে দৈনিক সাড়ে ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এখানে গ্যাস উত্তোলনের বিদ্যমান সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহৃত হচ্ছে না। ভোলায় বিদ্যমান পিডিবির ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা সাড়ে ৩ কোটি ঘনফুট। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের পাইপ লাইনে সমস্যার কারণে চাহিদার অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে। অথচ, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সক্ষমতার পুরোটাই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু শুধুমাত্র পাইপ লাইনের সমস্যার কারণে তা করা যাচ্ছে না। এই সমস্যা কিন্তু সহজেই সমাধানযোগ্য। এদিকে ২০১৭ সালে ভোলায় ভোলা নর্থ নামে আরো একটি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এতে মজুদকৃত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে এখনো গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়নি। একইভাবে ২০২১ সালে সর্বশেষ আবিষ্কৃত সিলেটের জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র হতেও এখনো গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়নি। অতএব, দ্রুত সময়ে এসব গ্যাসক্ষেত্র হতে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হোক। বাইরে সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র হতে সর্বোচ্চ পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। ভোলা যেহেতু একটি দ্বীপজেলা এবং এখানে ব্যাপক শিল্পায়নের সুযোগ কম, তাই ভোলার গ্যাসকে জাতীয় পাইপ লাইনে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ভোলা চারদিক দিয়েই পানি বেষ্টিত এবং দেশের মূল ভুখণ্ডের সাথে সড়ক পথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। ভোলা থেকে বরিশালের নদীপথের দূরত্ব সর্বোচ্চ ১২ কিলোমিটার। নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ নির্মাণ করে ভোলার গ্যাসকে বরিশালে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। তখন বরিশাল এবং খুলনায় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। পাশাপাশি ভোলায় আরো গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে এবং সেই বিদ্যুৎ জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে যুক্ত করে সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে লোডশেডিং কমিয়ে আনা যাবে।
এজন্য সরকারকে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে থেকে গ্যাস উত্তোলনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে এবং এখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল বাস্তবায়ন করে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে হলে এর কোনই বিকল্প নেই।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন