বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চ কক্ষ ব্রিটেনের ‘হাউস অব লার্ডস’ এর আদলে সৃষ্টি করা হবে। জনগণের ভোটে বিএনপি দেশ পরিচালনা তথা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলে যারা গণতন্ত্র, মানুষের বাকস্বাধীনতা, সুশাসন কিংবা আইনের শাসনে বিশ্বাস করে তাদেরকে নিয়ে আমরা জনমতের বা ঐক্যমতের সরকার গঠন করবো। একই সঙ্গে আমরা আর এক কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টে থাকবো না। আমরা সমাজের জ্ঞানী-গুণি, পেশাজীবী- যাদের দেশকে দেবার অনেক কিছু আছে এবং দেশের অনেক কিছু আছে তাদের কাছ থেকে পাওয়ার তাদেরকে নিয়ে আমরা ইনশাআল্লাহ দ্বি-কক্ষ বিশিষ্টি একটি সংসদ তৈরী করবো।
শনিবার দুপুরে রাজশাহী নগরীর একটি আবাসিক হোটেলের সম্মেলন কক্ষে ‘জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ অপরিহার্য’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির মিডিয়া সেল-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা শুধু নির্বাচন নিয়ে ভাবি। আর যারা রাষ্ট্রনায়ক ভাবেন- আগামী প্রজন্ম নিয়ে, শত বছর পর দেশ কোথায় যাবে সেটি নিয়ে। আমাদের সৌভাগ্য দেশনায় তারেক রহমানের মত একজন নেতা দলের হাল ধরেছেন। আগামীর রাষ্ট্র নায়কের মত চিন্তা করছেন, একশত বছর পর বাংলাদেশ কোথায় যাবে। তারই সূচনা হিসেবে আজ আমারা দুটি ধারনা নিয়ে এগুচ্ছি। একটি হচ্ছে- জাতীয় সরকার অন্যটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট।’
বিএনপি নির্বাচিত হলে দেশের জাতীয় সরকারের কেমন হবে তার ধারনা দিতে গিয়ে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এদেশের নির্বাচন কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকেই বলা হয়, দিনের ভোট নাকি রাতে হয়। নির্বাচনের কমিশন থেকে বলা হয়, আমাদের গোপন কক্ষে যে ভূত দাঁড়িয়ে থাকেন তারাই হচ্ছেন নির্বাচনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশন থেকেই স্বীকার করে নেয়, এদেশে নির্বাচন বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট নাই। এই নির্বাচন কাঠামো ধ্বংস করা, ধ্বংস করা হয়েছে আইনের শাসন, মানবাধিকার, ধ্বংস করা হয়েছে বিচার বিভাগের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধ্বংস করা হয়েছে ন্যায়বিচার পাওয়া। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামো। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যদি সরকার গঠন করতে পারে তখন তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার গঠিত হবে। নির্বাচনে মিত্র দলগুলো জয়ী হলেও তারা সরকারে থাকবে অথবা যদি হেরেও যায় তারপরও তারা সরকারে থাকবে। অর্থাৎ নির্বাচনে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা জয়লাভ না করতে পারলেও তাকে নিয়েই আমরা জাতীয় সরকার গঠন করবো।’
রুমিন ফারহানা বলেন, ‘জয়ী এবং বিজিতের যে মিলবন্ধন এটি অতীতে বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি। গত ১০ বছরে ধ্বংস করা হয়েছে সমাজ ও মূল্যবোধের মত বিষয়গুলো। সরকার হস্তক্ষেপে সব রাষ্ট্রীয় ও সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দলীয়করণ করা হয়েছে। এই অবস্থায় সমাজ, আইন-শৃঙ্ক্ষলা এবং সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন হলে হবে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে না। এজন্য পুরো রাষ্ট্রের মেরামত দরকার। আর এই মেরামতের জন্যই সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ঐক্যমত তৈরী করা দরকার। আর তাই দেশে অনেক ছোট দল আছে- যাদের অনেক বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ নেতা আছে তাদের নিয়েই আমরা এই রাষ্ট্র মেরামতের কাজটি করবো এবং দেশকে আবার গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধারায় আমরা ফিরিয়ে আনবো।’
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পরিকল্পনার ব্যাপারে বিএনপির এই নেত্রী আরও বলেন, ‘মধ্যযুগীয় সম্রাটশাসিত রাজ্যের সাথে গণতান্ত্রিক আধুনির রাষ্ট্রের যে মূল পার্থক্য যেটি হচ্ছে- ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগ একবারেই আলাদা থাকবে। এই তিনটি বিভাগের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালীভাবে কাজ করতে পারবে। একটি বিভাগ আরেকটি বিভাগের ওপরে কোনো খবরদারি করতে পারবে না। এটিই হচ্ছে ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ এর মূল কথা। কোনো দেশে যদি‘ ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ শক্তিশালীভাবে থাকে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তখন মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এমনকি শাসকের স্বার্থ লঙ্ঘিতও হয়। তাই এখন আর প্রাচীন সরকারগুলো কখনই ‘সেপারেশন অব পাওয়ার চায় না। তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস, দর্বল এবং দলীয়করণ করতে চায়।’
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সুচারুভাবে পরিচালনায় আইন বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তিনটি বিভাগের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- আইন বিভাগ। আইন বিভাগ যে শুধু আইন তৈরী করে তাই নয়;, আইন বিভাগ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করে এবং একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে একটা দিক নির্দেশনা দেয়। প্রথমত: পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা গেছে- এক কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার চেয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ রক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর। দ্বিতীয়ত: এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সমস্যা হলো- কোনো দল যদি নির্বাচনে ‘গ্রুপ মেজোরিটি’ পায় তখন সেটি স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। আর সেখান থেকেই কিন্তু দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ধারনার সূত্রপাত। কারণ, সরকারের পক্ষে একই সঙ্গে দুইটি কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেয়া ভীষণ কঠিন। দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকলে সেটি যেকোনো আইন বা রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনায় অনেক বেশি সময় পায়। এতে ‘ডিভিশন অব লেবার’ নিশ্চিত হয় যাতে সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ কক্ষের সদস্য হবার ন্যূনতম বয়স ও অভিজ্ঞতা বেশি বলে উচ্চ কক্ষ অনেক বেশি ‘ম্যাচিউরড’ পেতে কাজ করে। নিম্নকক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন এমনকি বাতিল করার ক্ষমতাও উচ্চ কক্ষ রাখে। সাধরণত ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোতে আমরা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট দেখি। কিন্তু আমরা দেখেছি- ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডের মত যারা এককেন্দ্রিক সরকার সেখানেও আমরা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট লক্ষ্য করছি। এজন্য বাংলাদেশেও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।’
আওয়ামী লীগ একটি ‘অগণতান্ত্রিক-ফ্যাসিস্ট সরকার’ মন্তব্য করে রুমিন ফারহানা বলেন, ‘বিএনপির দুর্ভাগ্য যে- আওয়ামী লীগের মত একদলীয় শাসন, বাকস্বাধীনতা, মানুষের অধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হওয়া একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সময় আন্দোলন এবং একটি ফ্যাসিস্ট একদলীয় ও বিভৎস সরকারের সময় আন্দোলন কখনো এক রকম হয় না। বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলনের মধে আছে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা অসংখ্য নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। অসংখ্য নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছে, অসংখ্য নেতাকর্মী বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা। এরপরও বিএনপি আন্দোলনের মধ্যে থেকে শক্তিশালী থেকে শক্তিশালীতর হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসন যদি সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে আওয়ামী লীগ কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন-এর সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমনের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, মোছা. শাম্মী আক্তার, সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর হেলাল, সাংবাদিক আলী মাহমুদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ডিন অধ্যাপক ড. ফজলুল হক, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস. এম আব্দুর রাজ্জাক, রাজশাহী বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আবুল কাশেম, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল প্রমুখ। অন্যদের মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের রাজশাহী বিভাগের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন