রাজধানীর ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গত রোববার সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। ইডেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা এবং তাদের অনুসারীরা এক গ্রুপে। অন্য গ্রুপে আছে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসসহ ২৫ জন নেত্রী ও তাদের অনুসারীরা। জানা যায়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ করে ২২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয় সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস। একারণে শনিবার রাতে তাকে আটকে রেখে হেনস্থা ও মারধোর করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা। এরই প্রতিক্রিয়ায় রোববার সন্ধ্যায় জান্নাতুল ফেরদৌস ও অন্য নেতাদের অনুসারীরা সংবাদ সম্মেলন করার সময় তামান্না জেসমিন রিভার ওপর হামলা করে। উভয় পক্ষ হামলা-প্রতিহামলায় জড়িয়ে পড়ে। পরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রতিপক্ষ গ্রুপ আগেই তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আগস্ট মাসে ছাত্রলীগের এককর্মীকে হেনস্থা করার অডিও ফাঁস হওয়ার পর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন করা ছাড়াও চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্য, এমন কি ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার মতো অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত। আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কিংবা কলেজ প্রশাসন কোনোরূপ পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা নেয়নি। শেষাবধি পরিস্থিতি সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও কলেজ প্রশাসন নড়াচড়া শুরু করেছে। ইডেন কলেজ দেশের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৩৫ হাজার ছাত্রী লেখাপড়া করে। এহেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মারামারি-হানাহানিতে জড়িয়ে পড়বে, সেটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অন্যদিকে ছাত্রলীগ এমন একটি ছাত্র সংগঠন, যার গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধে তার রয়েছে অশেষ অবদান। সেই ছাত্র সংগঠনের নেতারা অন্যায়, অপকর্ম ও অপরাধমূলক কাজে নিজেদের জড়িত করবে, সেটা ভাবতেও কষ্ট হয়। ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের অভিযুক্ত নেতারা কলেজ এবং সংগঠন উভয়কেই কালিমালিপ্ত করেছে।
বলা হয়, স্বাধীনতা পূর্বকালের ছাত্রলীগ আর স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ছাত্রলীগ এক নয়। দুই পর্বের ছাত্র লীগের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্য যেমন আদর্শের দিক থেকে রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতাকর্মীদের স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে। সংগ্রামশীল, আদর্শ ও নৈতিকভাবে বলবান, মানবিক, সহৃদয় ও দায়িত্বনিষ্ঠ একটি ছাত্র সংগঠন তার চরিত্র হারিয়েছে। ছাত্রলীগ এখন একটি ভীতিকর নাম। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপরাধ ও গর্হিত কর্ম নেই, যার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অর্থ-বিত্ত-বৈভরের শেষ নেই। এটা অতীতের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কল্পনাও করতে পারেনি। তাদের লোভ, ঈর্ষা, দখলদারি মনোভাব এতই বেড়েছে যে, অর্থ-মোক্ষ অর্জনের জন্য তারা যাচ্ছেতাই করতে পারে। ক্ষমতা ও প্রভাব রক্ষায় আপন সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হতে, খুন-জখম করতে তাদের হাত এতটুকু কাঁপে না। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ-সংঘাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত কর্মী নিহত ও আহত হয়েছে। দেশে গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করছে। কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে। শুধু কিশোর গ্যাং নয়, কিশোরী গ্যাংও দেখা যাচ্ছে। আগে কখনো কখনো ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত দেখা যেতো। ছোটখাটো মারামারিও ক্ষেত্রবিশেষ হতো। কিন্তু ছাত্রীরা মারামারি করেছে, এমনটি দেখা যায় না। এখন ছাত্রীরাও মারামারিতে পিছিয়ে নেই। ইডেন কলেজের উদাহরণ তো সামনেই আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ মারামারির নজির রয়েছে। কিশোর গ্যাং, তরুণ ও যুবকদের সংঘবদ্ধ সহিংসতা, মারামারি ও হানাহানি মোটেই কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বলাই বাহুল্য, ইদানিংকার সংঘাত, সংঘর্ষ ও হানাহানির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, আর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ইত্যাদির নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে তাদের দ্বারা যা ঘটছে, তার অধিকাংশই বিভিন্ন মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারছে। কিন্তু গ্রামে সমাজ-সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী ঘটছে, তার চিত্র ও বিবরণ অত্যন্ত কমই মানুষের নজরে আসছে। কী ঘটছে গ্রামাঞ্চলে?
আজ যারা ছাত্রলীগ করছে, তাদের সুযোগ-সুবিধার অন্ত নেই। গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। সেই হিসাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই সময়কালে চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বা থাকবে, ততদিন এই প্রাধান্য অটুট থাকবে। ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-চরিত্র তাদের কর্ম বা পেশাজীবনে প্রতিফলিত হবে, এটাই সংগত। পর্যবেক্ষক মহল শংকিত এই ভেবে যে, প্রশাসন, আইনশৃংখলা বাহিনী এবং শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারা নিয়োগ পেয়েছে বা এখনো পাচ্ছে, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও মান সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এমতাবস্থায়, আগামীতে দেশ কেমন চলবে, আন্দাজ করা অসম্ভব নয়। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। সরকার কেমন দেশ রেখে যাচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যাবে, আসবে। কিন্তু যে সরকার সব ক্ষেত্রে অগ্রসরমান, শান্তিপূর্ণ, সুশাসিত দেশ রেখে যাবে, সেই সরকারই ইতিহাসে নন্দিত হবে। এই জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয়টি সামনে রেখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাত্রলীগ সরকারের জন্য এখন আর সম্পদ নয়, বোঝাস্বরূপ। এ বোঝা ঝেড়ে ফেলতে হবে। একটা পরিশোধন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে ছাত্রলীগকে। পরিশোধনকৃত ছাত্রলীগ সরকারের জন্য যেমন উপকারী হবে, তেমনি দেশবাসীর জন্যও। আমরা আশা করবো, ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ব্যাপার অনুপুংখ তদন্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনে রাখতে হবে, দুষ্ট ষাঁড়ের চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন