গত বেশ কিছুদিন যাবত কয়েকজন শিক্ষাবিদ আমাকে ঢাকা আলিয়া নিয়ে একটি লেখা লিখতে আনুরাধ করে আসছেন। অনুরোধটি আমি শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছি। কারণ, ঢাকা আলিয়া উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বলতে গেলে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমানদের একমাত্র উচ্চতর প্রতিষ্ঠান ছিল এ মাদ্রাসা। কিন্তু আজকের দিনে সে প্রতিষ্ঠানটির দৈন্যদশা সবাইকে ব্যথিত করে তুলেছে। শিক্ষা-দীক্ষা আর জ্ঞানচর্চায় সমগ্র বিশ্ব যখন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে, প্রাচীন বিখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানটি তখন সমান গতিতে পিছিয়ে পড়েছে। এক সময় দেশের প্রবীণ প্রাজ্ঞগণের অনেকেই এ মাদ্রাসা থেকে সরকারি স্টাইপেন্ড পেয়ে সম্মানিত হয়েছিলেন। সরকারিভাবে প্রদত্ত এ স্টাইপেন্ড দেশের মেধাবীদের এখানে ভর্তি হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। বর্তমানে মাদ্রাসাটি অযত্ম আর অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এটি ঢাকা আলিয়া নামে সমধিক পরিচিত। বাংলার তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে এটি কলকতায় প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্তির সময় এটি কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হবার পর এর নামকরণ করা হয় মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১৯৫৮ সালে ঢাকার বখশীবাজারে এ মাদ্রাসার চারতলা ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতে পরবর্তী ২০ বছর যাবত এটি আলিয়া মাদ্রাসা বোর্ড অব গভর্নরস দ্বারা পরিচালিত হয়। পরবর্তী ৩০ বছর খৃস্টান সেক্রেটারী ও মুসলিম সহকারী সেক্রেটারীর অধীনে ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৮৫০ সালে সর্বপ্রথম এ মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল পদ সৃষ্টি হয়। ড. এ. স্প্রেঙ্গার সর্বপ্রথম প্রিন্সিপাল পদে নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত খৃস্টান শিক্ষাবিদগণ এ পদটি অলঙ্কৃত করেন। প্রতিষ্ঠার প্রথম ২৬ জনই ছিলেন ইউরোপীয় খৃস্টান অধ্যক্ষ। মোট ৩০ জন অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালনের পর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯২৭ সালে খাজা কামাল উদ্দীন আহমদ মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন। এসময় থেকে মাদ্রাসাটিতে ইসলামী শিক্ষা বেগবান হতে শুরু করে এবং মুসলিমদের প্রভাব সৃষ্টি হতে থাকে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত মোট ৫৮ জন অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। বর্তমানে এ পদটি শূন্য রয়েছে।
ইংরেজ শাসনের প্রাথমিক পর্বে মাদ্রাসার প্রশাসন পরিচালিত হতো প্রচলিত ফার্সি ভাষায় প্রণীত আইন অনুসারে। একারণে প্রশাসন ও বিচার বিভাগের জন্য সেসময় ফার্সি জানার প্রয়োজন ছিল। এছাড়া মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা ও মামলা পরিচালনা করতে প্রয়োজন ছিল আরবী ও বাংলা ভাষা। সাধারণত এক্ষেত্রে মৌলভী ও মুফতি সাহেবদের বেশ প্রয়োজন ছিল। প্রশাসনের কর্তারা ইংরেজ হওয়ায় আরবী, বাংলা ও ফার্সির পাশাপাশি ইংরেজী ভাষা জানারও গুরুত্ব ছিল সীমাহীন। এমন পরিস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মুসলমানদের জন্য একটি মাদ্রাসা আর হিন্দুদের জন্য একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৯ সালে মাদ্রাসাতে ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার সিলেবাসে ফার্সি ভাষা মুখ্য স্থান দখল করে নেয়। গণিত হিসেবে শুধুমাত্র অনুপাত ও সমানুপাত পর্যন্ত সিলেবাস সীমিত থাকে। এর পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের কিছু পাঠ সংক্ষিপ্তাকারে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭৮০ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল, এ ৭৯ বছর পর্যন্ত মাদ্রাসাটিতে ১৭৮৭ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন। এঁদের মধ্যে নওয়াব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। এখানে ভর্তি হতে উঁচু বংশে জন্মের সনদপত্রকে বিশেষভাবে জোর দেয়া হতো। ১৮৫৪ সালে এ মাদ্রাসাটিকে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হলেও পরবর্তীতে তা কার্যকর হয়নি। ১৯০৭ সালে মাদ্রাসাটিতে তিন বছর মেয়াদী কামিল কোর্স চালু করা হয়। ১৯৪৭ সালে এ মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার বছর থেকে ঢাকা আলিয়া নামে পরিচিতি পায়। ঢাকা আলিয়ার প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক। ঢাকার লক্ষীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে নজরুল কলেজ) মাদ্রাসার কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১১ মার্চ বখশীবাজারে মাদ্রাসার ৪ তলা ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬১ সালে মাদ্রাসাটি বখশীবাজারের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
মাদ্রাসাটিতে ৫টি স্তরে ৩৯টি শ্রেণি রয়েছে। ইবতেদায়ী ৫ম শ্রেণি হতে দাখিল দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৬টি শ্রেণি রয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণিতে সাধারণ, বিজ্ঞান ও মুজাব্বিদ-এ তিনটি শাখা রয়েছে। আলিম শ্রেণিতে সাধারণ, বিজ্ঞান ও মুজাব্বিদ শাখা চালু আছে। প্রতিটি শাখায় ১ম বর্ষ ও ২য় বর্ষ নামে মোট ৬টি শ্রেণি রয়েছে। ফাযিল বা বি.এ স্তরে তিন বছর মেয়াদী ফাযিল স্নাতক কোর্সে বি.এ, বিটিআইএস ও বিএসএস-এ তিনটি বিভাগ চালু আছে। প্রতিটি বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষ নামে মোট ৬টি শ্রেণি রয়েছে। কামিল বা এম.এ স্তরে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও আদব-এ ৪টি বিভাগ চালু আছে। প্রতিটি ভিভাগের অধীনে ১ম ও ২য় পর্ব নামে ২টি করে মোট ৮টি শ্রেণি রয়েছে। ফাযিল ¯স্নাতক (সম্মান) স্তরে ২০১০-২০১১ সেশন থেকে প্রথমবারের মত ৪ বছর মেয়াদী ফাযিল ¯স্নাতক (অনার্স) কোর্স চালু হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া-এর অধীনে ২০১০-২০১১ বর্ষ থেকে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকায় আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ খোলা হয়। আর ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-এর অধীনে ২০১৫-২০১৬ সেশন থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ও আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ খোলা হয়। এছাড়া ২০১৪-২০১৫ সেশন থেকে উল্লেখিত ৫টি বিভাগেই ১ বছর মেয়াদী কামিল (মাস্টার্স) কোর্স চালু হয়েছে। ফাযিলের অনার্স কোর্সে প্রতিটি বিভাগের অধীনে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ বর্ষ নামে অনার্স এবং মাস্টার্স নামে ৫টি করে মোট ১০টি শ্রেণি রয়েছে। অনার্সের বাইরে মাদ্রাসাটিতে আরো যে সমস্ত বিভাগ রয়েছে সেগুলো হলো: ১. আল কুরআন বিভাগ, ২. তাফসীর বিভাগ, ৩. আল হাদীস বিভাগ, ৪. প্রাচীন আরবী বিভাগ, ৫. আধুনিক আরবী বিভাগ, ৬. আকাঈদ বিভাগ, ৭. ফিকহ বিভাগ, ১৩. ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ৮. ইসলামী শিক্ষা বিভাগ, ৯. বাংলা বিভাগ, ১০. অর্থনীতি বিভাগ, ১১. গণিত বিভাগ, ১২. রসায়ন বিভাগ, ১৩. উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগ, ১৪. পদার্থ বিদ্যা বিভাগ, ১৫. রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, ১৬. পৌরনীতি বিভাগ, ১৭. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ও ১৮. ইংরেজি বিভাগ।
এসমস্ত বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ গ্রাজুয়েটদের জীবনে রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিসিএস প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডার, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা, বেসরকারি কলেজ-মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত দক্ষতা, নিষ্ঠা এবং সততার সাথে তাদের সেবা অব্যাহত রেখে চলেছেন অব্যাহতভাবে। এসব গ্রাজুয়েট দেশপ্রেম আর ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে মোটিভেশনাল কার্যক্রমে ব্যস্ত আছেন সারাক্ষণ। কিন্তু বর্তমান মাদ্রাসাটির শিক্ষা ও প্রশাসনিক-সকল বিষয়াদি এক ভঙ্গুর দশায় উপনীত হয়েছে। এমনিতেই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মাদ্রাসা শিক্ষা সামগ্রিকভাবে দৈন্যদশায় রূপান্তরিত হয়েছে। সারাদেশে সরকারি স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৬০০ আর সরকারি কলেজের সংখ্যাও ৬০০টির বেশি হলেও সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র ৩টি! তা ও এ তিনটি মাদ্রাসা পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত সরকারি মাদ্রাসা। তার মানে, বাংলাদেশ আমলে একটি মাদ্রাসাও সরকারি করা হয়নি! ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় আল্লামা কাশগারী ও শহীদ ইব্রাহীম নামে দুটি হল রয়েছে। এছাড়া একটি ক্যান্টিন, খেলার মাঠ, গবেষণাগার ও সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি রয়েছে। ২৩৫ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরি তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও শ্রেষ্ঠতম লাইব্রেরি বলে বিবেচনা করা হতো। এ লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার দুস্প্রাপ্য ও প্রাচীন গ্রন্থ রয়েছে। আরবী, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থে লাইব্রেরিটি সমৃদ্ধ। কিন্তু আজকের দিনে সে লাইব্রেরিটি জরাজীর্ণে পরিণত হয়েছে। বইগুলোতে ময়লার স্তুপ পড়ে থাকলেও পড়ার মত কোনো শিক্ষার্থী সেখানে পাওয়া যায় না। মাদ্রাসাটিতে বিগত কয়েক বছর যাবত একটি অস্থায়ী আদালত বসানো হয়েছে। এছাড়া সরকার এখানে মাদ্রাসাঅধিদপ্তরের অফিস করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রবল আপত্তির মুখে এটি কার্যকর করতে আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে সরকার এটা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।
মাদ্রাসায় অস্থায়ী আদালত ও মাদ্রাসা অধিদপ্তরের অফিস বানানো সাধারণ জনতার মাঝে সন্দেহের উদ্রেক সৃষ্টি করেছে। তাদের প্রশ্ন হলো, দেশের এত জায়গা রেখে একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসা অধিদপ্তরের অফিস নির্মাণ ও আদালত স্থাপনের কারণ কী? তারা মনে করেন, এখানে আদালত স্থাপন এবং মাদ্রাসা অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণ করা হলে মাদ্রাসাটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং মাদ্রাসাটি তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে। ফলে মাদ্রাসাটি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবে।
মাদ্রাসাটির অবকাঠামোগত অবস্থানও খুব একটা ভালো নয়। ১৯৪৭ সালের পরে এখানে কোনো ভবন নির্মিত হয়নি। মাদ্রাসাটিতে নির্মিত ভবনগুলো সবকটিই পাকিস্তান আমলে নির্মিত। পুরাতন সবগুলি ভবন অতিশয় জীর্ণকায় দাঁড়িয়ে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে যাচ্ছে। মাদ্রাসাটি ইংরেজরা তাদের প্রশাসন চালানোর জন্য নির্মাণ করলেও ভারত বিভাগের পর মুসলিমদের কাছে এটি একটি উচ্চতর দ্বীনী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশ ও জাতি গড়ার মহান পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে এটির অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে। শিক্ষা কারিকুলামে মাদ্রাসাটির অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সেটি এখন নিজেই একটি ভঙ্গুর দশায় রূপান্তরিত হয়েছে।
এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত বিবেচনায় বুঝা যায় যে, এটি তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিখ্যাত উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশেষত: ভারতীয় ও বাঙ্গালী মুসলিমদের জন্য এটি এক অনন্য ও অসামান্য বিদ্যাপিঠ হিসেবে বিবেচিত হতো। দেশ বিভাগের পর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেলেও বাংলার প্রথম উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা। কিন্তু শুধুমাত্র বৈশি^ক নেতিবাচকতা ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। উচ্চতর শ্রেণিগুলোতে এখন এখানে কোনো ক্লাস হয় না বললেই চলে। এখন শুধুমাত্র এটি পরীক্ষা আর সনদ নির্ভর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। আগে উচ্চতর জ্ঞান-গবেষণা, তাফসীর, হাদীস ও সাহিত্য পাঠদানের জন্য এখানে দেশ বরেণ্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অনারারি টিচিং-এর ব্যবস্থা ছিল। এখন আর সেটার কোনো ব্যবস্থা এখানে নাই। মাদ্রাসাটিতে পাঠদানের উদ্দেশ্যে বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত অনেকেই ঢাকা বিশ^্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ হতে পাশকরা। তাদের অনেকের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কুল ও কলেজ হওয়ায় তারা মাদ্রাসার কুরআন-হাদীসের ন্যুনতম পাঠদান করতে সক্ষমতা রাখেন না। ফলে সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসাটি মারাত্মক সংকটে ভুগছে। অনার্স লেভেলে ক্লাস হলেও উপস্থিতির হার খুবই কম। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে শিক্ষক সংকট চরম আকারে পৌঁছেছে; যে কারণে এখানে পাঠদানে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ৩২ জন! দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত মাদ্রাসাটিতে অধ্যক্ষের পদটি শূন্য রয়েছে। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ষোলতম বিসিএস-এর শিক্ষা ক্যাডার ও সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ। মাদ্রাসাটিতে প্রভাষক পোস্ট খালি আছে ১৬টি। সহকারী অধ্যাপক পোস্ট খালি আছে ৪টি। হেড মাওলানা তথা অধ্যাপক পোস্ট খালি আছে ১টি। সহকারী শিক্ষক তথা মৌলভী পদ খালি আছে ১০-এর অধিক। এ পদগুলো দীর্ঘদিন যাবত খালি থাকলেও নিয়োগ প্রদানে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই।’ এ থেকে স্পষ্ট, বর্তমানে মাদ্রাসাটি মোটেই ভালো নেই। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন-কোনোটির অবস্থাই সন্তোষজনক নয়। এমতাবস্থায় মাদ্রাসাটি রক্ষার জন্য আশু পদক্ষেপ জরুরি। আমরা এর ঐতিহ্য স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি!
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন