গত ১৫ বছর ধরে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগত প্রায় তিন শতাধিক প্রবাসীকে কৌশলে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নেয়া চক্রের মূলহোতা ও ১৫টির অধিক মামলার আসামী মো. আমির হোসেনকে তার ৩ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব জানায়, আমির এই বিমানবন্দর কেন্দ্রীক একটি অজ্ঞান পার্টি চক্রের মূলহোতা। সে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিমানবন্দর এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরির আড়ালে গত ১৫ বছর হরে এই অপকর্মের সাথে জড়িত।
বিভিন্ন পেশার আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে এই চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বিমানবন্দর টার্মিনালে ওত পেতে থাকে এবং বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের টার্গেট করার জন্য বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাস ফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করে তাদের সাথে সখ্যতা গোড়ে তোলে। এরপর একই এলাকার পরিচয় দিয়ে গাড়ী বা বাসে ভ্রমণের সময় চক্রের সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তিকে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত বিস্কুট খাইয়ে অচেতন করত। ভিকটিম অজ্ঞান হয়ে গেলে তার কাছ থেকে যাবতীয় মালামাল নিয়ে চক্রটি পরবর্তী স্টেশনে নেমে যেত। গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০০ জন ভুক্তভোগীকে অজ্ঞান করে তাদের কাছ মূল্যবান মালামাল ও সম্পদ লুট করেছে।
শনিবার রাতে র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর বিমানবন্দর থানা ও কদমতলী থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অজ্ঞান পার্টি চক্রের মূলহোতা (১) মো. আমির হোসেন, মো. লিটন মিয়া ওরফে মিল্টন (৪৮), আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে পারভেজ (৩৫) এবং জাকির হোসেনকে (৪০) গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় উদ্ধার করা হয় মোবাইল ফোন, অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত ট্যাবলেট, যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণে ব্যবহৃত লাগেজ ও চোরাইকৃত স্বর্ণ।
রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, গত ২ সেপ্টেম্বর কুয়েত প্রবাসী জনৈক ব্যক্তি হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এ সময়ে এয়ারপোর্টে আগে থেকে ওত পেতে থাকা অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে টার্গেট করে ও ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথিমধ্যে তাকে অজ্ঞান করে তার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে ভিকটিম বাদী হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং ১২। র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে এবং হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানায়, তারা সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টি চক্রের সদস্য। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে পারস্পারিক যোগসাজসে রাজধানীর বিমানবন্দর টার্মিনালে ওত পেতে থাকে এবং বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের টার্গেট করার জন্য বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাস ফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করে। এটি মূলত তাদের একটি কৌশল।
র্যাব মুখপাত্র জানান, পরবর্তীতে এই চক্রটি এমন প্রবাসী যাত্রীদের টার্গেট করত, যার জন্য অপেক্ষমান কোন আত্মীয় স্বজন বা গাড়ী নেই। তারা কৌশলে বিদেশ ফেরত ব্যক্তির সাথে কুশল বিনিময় করে চক্রের অন্য সদস্যদের তাদের কাছের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিত। পরবর্তীতে ভিকটিমের সাথে একই এলাকার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করত। পরবর্তীতে এই চক্রের সদস্যরা সবাই একসাথে বাসের টিকেট কেটে যাত্রা শুরু করত। গাড়ী বা বাসে ভ্রমণের সময় চক্রের সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তিকে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত বিস্কুট খাইয়ে অচেতন করত। পরবর্তীতে টার্গেট ভিকটিম অজ্ঞান হয়ে গেলে তার কাছ থেকে যাবতীয় মালামাল নিয়ে চক্রটি পরবর্তী স্টেশনে নেমে যেত।
কমান্ডার খন্দকার মঈন বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর ভোর বেলা কুয়েত প্রবাসী একজন ভিকটিম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছায়। এরপর চক্রটির একজন সদস্য বিমানবন্দর থেকে প্রবাসীকে অনুসরণ করতে থাকে। ভিকটিম উত্তরবঙ্গে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছায় এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারে টিকেট কাটতে গেলে কাউন্টারে আগে থেকে প্রবাসী যাত্রীর ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা গ্রেপ্তার আমির হোসেন ভিকটিমকে জানায় তার কাছে একটি অতিরিক্ত বাসের টিকেট রয়েছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আগে থেকে সাজিয়ে রাখা একটি লাগেজ ও কিছু কুয়েতি দিনার দেখিয়ে সে ভিকটিমকে আশস্ত করে সে নিজেও একজন প্রবাসী। ভিকটিম আমির হোসেনকে বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে টিকেট কিনে পাশের সীটে বসে বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে চক্রের মূলহোতা আমির হোসেন ভিকটিমকে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো বিস্কুট খেতে দেয়। ভিকটিম বিস্কুট খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং চক্রটি ভিকটিমের সব মালামাল ও সম্পদ লুট করে নিয়ে পথেই নেমে যায়। পরবর্তীতে বাসের সুপারভাইজার ভিকটিমকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আমির হোসেন জানায়, সে বিমানবন্দর কেন্দ্রীক একটি অজ্ঞান পার্টি চক্রের মূলহোতা। সে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে। পরবর্তীতে সে বিমানবন্দর এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরির আড়ালে গত ১৫ বছর হরে এই অপকর্মের সাথে জড়িত। দীর্ঘ এই সময়ে সে প্রায় ৩০০ জন ভুক্তভোগীকে অজ্ঞান করে তাদের কাছ মূল্যবান মালামাল ও সম্পদ লুট করে নিয়েছে বলে জানায়।
তিনি আরও বলেন, চক্রের আরো ৬-৭ জন বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিল যার মধ্যে একাধিক সদস্য বর্তমানে কারাগারে অবস্থান করছে বলে জানায়। গ্রেপ্তার আমির হোসেনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে এবং সে একাধিকবার কারাভোগ করেছে। বর্তমানে সে জামিনে রয়েছে।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার লিটন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে এবং লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে সে মাইক্রোর ড্রাইভার পেশার আড়ালে দীর্ঘ ৩/৪ বছর ধরে আমিরের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে। এর আগে একাধিকবার একই ধরণের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল। বিভিন্ন সময় চক্রটি কৌশলে প্রবাসী যাত্রীদের মাইক্রোবাসে পরিবহন করে সর্বস্ব লুট করে নেয়। তখন সে মাইক্রোবাসের চালনার দায়িত্বে থাকে। এছাড়াও সে বিভিন্ন সময় বিমানবন্দর হতে যাত্রীদের অনুসরণের কাজ করে থাকে।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার আবু বক্কর ৮/৯ বছর বিভিন্ন জুয়েলারী দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। পরবর্তীতে গত ৬/৭ বছর আগে নিজেই রাজধানীর শ্যামপুরে নিজের জুয়েলারীর দোকান প্রতিষ্ঠা করে। জুয়েলারী দোকানের আড়ালে সে গত ২/৩ বছর ধরে চক্রটির লুট করা স্বর্ণ গ্রহণ, রুপ পরিবর্তন ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিল।
গ্রেপ্তার জাকির হোসেন ছাপাখানার ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। গত ৩/৪ বছর আগে আমিরের মাধ্যমে এই চক্রে যোগ দেয়। সে লুটকৃত স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মালামাল রাজধানীর বিভিন্ন জুয়েলারী দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির সাথে জড়িত ছিল বলেও জানায় র্যাবের এই কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন