দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই হ্রদ (কর্ণফুলী হ্রদ)। এ হদ্র বাংলাদেশের বদ্ধ জলাশয় সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং মিঠা পানির মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। এ হ্রদের আয়তন ৬৮৮০০ হেক্টর এবং এর জলায়তন ৫৮,০০০ হেক্টর যা আভ্যন্তরিণ জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ লেকটি মূলত তৈরি হলেও মৎস্য উৎপাদন, কৃষিজ উৎপাদন, জলপথে যাতায়াত, ফলজ ও বনজ দ্রব্য দুর্গম পথে পরিবহন, জেলে, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে মৎস্য সেক্টরে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
এ হ্রদকে ঘিরেই পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। রাঙামাটির অন্যতম ব্যবসা মাছ ও কাঠ ব্যবসা। যা কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্ভরশীল। কাপ্তাই হ্রদের মাছ রাঙামাটির চাহিদা মিঠিয়ে জেলার বাইরে বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা মেটায়।
এ ছাড়া পার্বত্য রাঙামাটি জেলার সবগুলো উপজেলার সাথে এখনো সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেনি। এখনো অধিকাংশ উপজেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। এ নৌপথ গড়ে উঠেছে কাপ্তাই হ্রদের উপর। কাপ্তাই হ্রদ বা লেকের কারণেই রাঙামাটির পর্যটন শিল্প পেয়েছে অন্যরকম প্রাণ শক্তি। লেক ভ্রমণ ও জেলার বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান পরিদর্শনে সারা বছরই এখানে পর্যটকের ভিড় থাকে।
সবদিক চিন্তা করে এই লেকের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা, এর দূষণ রোধ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হ্রদ বাঁচলে রাঙামাটির মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা ঠিক থাকবে। লেকের পরিবেশ ঠিক থাকলে মাছ বাঁচবে।মাছ বাঁচলে জেলেরা বাঁচবে। হ্রদের পানির পরিবেশ ভাল থাকলেই এই হ্রদ পর্যটক আকৃষ্ট করবে।
এদিকে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর রাঙামাটি নদী কেন্দ্রের এক গবেষণা রিপোর্টে সুত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদের পানি এখনো দুষিত হয়ে যায়নি। হ্রদের জলাশয়ত্বাত্তিক গবেষণা অনুযায়ী পানির গুণাগুণ বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, হ্রদের পানির তাপমাত্রার বর্তমান অবস্থা ২৬-৩২ (০সে), এর আদর্শ মান হলো ২৫-৩২(০সে)। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের বর্তমান অবস্থা ৬.৩৯-৬.৫১(মিগ্রা./লি.), এর আদর্শ মান হলো ৫.৬-৮.৫(মিগ্রা./লি.)। পি.এইচ এর বর্তমান অবস্থা ৭.৫-৭.৯(ঢ়ঐ), এর আদর্শ মান ৬.৫-৮.৫(ঢ়ঐ)। সামগ্রিক হার্ডনেস বর্তমান অবস্থা ৪৯-৭৬(মিগ্রা./লি.), এর আদর্শ মান হলো ৪০-৪০০(মিগ্রা./লি.)। সেকিডিক্স স্বচ্ছতা বর্তমান অবস্থা ১.২-১৭৯(মিটার), এর আদর্শ মান হলো ১.৬-৬.০৯(মিটার)। মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড এর বর্তমান অবস্থা ১২.২-১৬.৫(মিগ্রা./লি.), এর আদর্শ মান হলো ৬.০-১২.৩(মিগ্রা./লি.)। লবণাক্ততা এর বর্তমান অবস্থা ০.০২-০.০৪(পিপিটি), এর আদর্শ মান হলো ০.০৫(পিপিটি)। অ্যামোনিয়া এর বর্তমান অবস্থা হলো ০.০৩-০.০৪(মিগ্রা./লি.), এর আদর্শ মান হলো ০.৫(মিগ্রা./লি.) ও অ্যালকালিনিটি এর বর্তমান অবস্থা ৬৭.৩-৯১.৮(মিগ্রা./লি.), এর আদর্শ মান হলো ৫০-১৫০(মিগ্রা./লি.)। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর রাঙামাটি অফিস সুত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদের পানির গুণাগুণ প্রতি মাসে বিশ্লেষন করাহয়। এতে বলা কাপ্তাই হ্রদে এখনো মাছের মড়কের নজির নেই।
অপরদিকে, দিনের পর দিন হ্রদের পরিবেশ যে হারে নষ্ট হচ্ছে তা পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জন্য হুমকি স্বরুপ। এক সময় এ হ্রদে প্রচুর কার্প জাতীয় মাছ পাওয়া যেত। তখন রুই বা কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন ৮১.০০ শতাংশ ( ১৯৬৫ Ñ ৬৬সালে) বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ০.৮৪ (২০২১ Ñ ২০২২) শতাংশ হয়েছে। এক সময় লেকের পানি প্রচন্ড রকমের স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কাপ্তাই লেকের পানির সেই অতি স্বচ্ছতায় কিছুটা মলিনতা এসেছে।
কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেষে যেসব বসত-বাড়ি গড়ে উঠেছে তার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত নির্মান। বেশিরভাগ বাড়ির খুটিগুলো বর্ষায় লেকের পানি বাড়লে পানিতে ডুবন্ত থাকে। লেকের ধারে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির টয়লেটের টাংকি থাকে ঘরের নিচে। বর্ষার সময় হ্রদে পানি বাড়লে তা ডুবে যায়। এছাড়া খোঁজ করলে এমন কিছু বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে যেসব বাড়িতে মানুষের বর্জ্যের কোন টাংকিই নেই। মানুষের বর্জ্য সরাসরি পড়ছে হ্রদের পানিতে। হ্রদের তীর ঘেষে গড়ে উঠা বস্তিতে বসবাসকারী লোকজনের ময়লা, আবর্জনা, বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত কাপ্তাই লেকের পানি। এতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কাপ্তাই হ্রদ এখন পয়ো নিষ্কাশনের ভাগারে পরিনত হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকরা হ্রদে যে হারে বিভিন্ন প্রকার প্লাষ্টিক দ্রব্য ফেলছে তাতে আশংকা করা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ প্লাস্টিক বা পলিথিনের বিছানায় পরিনত হবে। এসব প্লাষ্টিক এক সময়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ক্ষুদ্র প্লাষ্টিক কণাতে রূপান্তরিত হবে। এ ক্ষুদ্র প্লাষ্টিক কনা গুলো ছোট মাছেরা খায়, আর এ ছোট মাছ গুলো বড় মাছেরা খায়। পরে এই বড় মাছগুলো মানুষে খাচ্ছে। এতে ফুড চেইন বা খাদ্য শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ছে। বিগত সময়ে একটি গবেষনা সুত্রে জানা গেছে, মানুষের শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রো প্লাষ্টিক কণা প্রথমে রক্তে এবং পরে ফুসফুসেও পাওয়া গেছে। অপরদিকে, এখানে হ্রদে আসা ঢলের পানি এখন আগের মতো সহজে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হচ্ছে না।
এই জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা হ্রদের জলরেখা ধরে কাপ্তাই, সুভলং, বরকল কিংবা লংগদু ঘুরে বেড়ানো। বিশাল নীল জলরাশি, চারপাশে বিস্তৃত বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়-সবকিছু মিলে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এই হ্রদ ঘিরে।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরলয়ে বদলে যাচ্ছে হ্রদের চিত্র। হ্রদের পার ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে বহুতল অট্টালিকা, বাড়িঘর, হোটেল, মোটেল প্রভৃতি। এসবের বর্জ্যও নির্বিবাদে পড়ছে হ্রদে। এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ প্রতিরোধও দেখা যায় না।
এছাড়া লেকের প্রধান বাহন যান্ত্রিক বোট ও লঞ্চ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তৈলের বেচা কেনায় লেকের বুকে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভাসমান তৈলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পানিতে তৈল জাতীয় পদার্থ পড়লে তা পানির দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। তাছাড়া যান্ত্রিক সেসব বাহনের তৈল তো পড়ছেই।
লেকের পানি কমলে বিভিন্ন জায়গায় চরের সৃষ্টি হয়। যেখানে কৃষকরা বিভিন্ন শস্য ফলান। আর সেসব শস্যের বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার। যা বর্ষায় লেকের পানিতে মিশে লেকের পানিকে দূষিত করছে। তাই শুষ্ক মৌসুমে লেকের অভ্যন্তরে সেসব কৃষিতে বিকল্প পরিবেশ বান্ধব সার প্রয়োগে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
কাপ্তাই লেক আমাদের সম্পদ। এ সম্পদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কোন অবস্থাতেই আমরা এ দায়িত্ব এড়াতে পারিনা। লেক বাঁচলেই রাঙামাটির জনজীবনের উন্নয়ন গতি বাড়বে। লেক বাঁচলেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবো। লেকের পরিবেশ ভাল থাকলে আমাদের পর্যটন শিল্প আরো নতুন মাত্রা পাবে। তাই এই লেকের পরিবেশ ঠিক রাখতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
যে সমস্ত বাসা বাড়ির মানুষ্য বর্জ্য টাংকি লেকের পানির উচ্চতা স্তরের নিচে, তাদের বর্জ্য ট্যাংক পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা স্তরের উপরে স্থাপনের ব্যবস্খা করা উচিৎ। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ কাজ সম্ভবপর নয়। প্রশাসন সঠিক মনে করলেই এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। আর যেসব বাড়ির টয়লেটের আবর্জনা সরাসরি লেকের পানিতে পড়ে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
বাসা বাড়ির পেছনে যত্রতত্র যেন ময়লা আবর্জনা না ফেলে এবং বাসার পেছনে লেক সংলগ্ন অংশ যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গ্রীষ্মে যেসব নৌযান নির্মাণকাজ হয় তাদের নির্মাণ পরবর্তী পানি দূষণকারী বস্তুগুলো পরিষ্কারের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নিয়মমতো এ কাজগুলো করতে পারলে লেকের পানি দূষণ অনেকটাই কমে আসবে।
আসুন আমরা কাপ্তাই লেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি । কাপ্তাই লেক দূষণ মুক্ত করি। কচুরিপানার কারণে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে রাঙামাটি হ্রদে বেড়াতে গিয়ে কচুরিপানার জটে পড়ছে। ফলে তারা আনন্দ বিমুখ হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ললিত সি চাকমা বলেন, হ্রদ ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত আছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যেসব বিভাগ ও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হ্রদের উপকারভোগী তাদেরও নিজ কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। “ভুলে গেলে চলবে না এই হ্রদ এখন জেলাবাসীর খাবার, ব্যবহার্য পানির যেমন প্রধান উৎস, তেমনি নৌ যোগাযোগেরও একমাত্র মাধ্যম।”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন