রাশিয়ায় আলু রফতানির দুয়ার খুলেছে। বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল রাশিয়া। সাত বছর পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। এখন আর সেখানে আলু রফতানিতে কোনো বাধা নেই। এটা দেশের জন্য একটা বড় রকমের আশার খবর বটে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আলুতে ভাইরাস পাওয়ার অভিযোগে রাশিয়ায় আলু রফতানি বন্ধ হয়েছিল। ধারণা করা হয়, ভাইরাস পাওয়ার বিষয়টি ছিল স্যাবোটাজ। যাহোক, এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে আরো সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে আলু রফতানি হয়ে থাকে। তবে পরিমাণে কম। ওইসব দেশে আলুর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। চাহিদার বিপরীতে আলু রফতানি তেমন একটা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। গত বছর বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ আলু রফতানি হয়েছে ৫২ হাজার টন। শুধু রাশিয়া বা ইউরোপ নয়, বাংলাদেশের আলু রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে। বলা জরুরি যে, আলু রফতানির ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ-প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। হলে রফতানি বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। সে ক্ষেত্রে উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু নিয়ে বিপাকে পড়তে হতো না এবং আলু পঁচে নষ্ট হতো না। কৃষি তথ্য সার্ভিস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ টনের মতো। গত চার-পাঁচ বছরের হিসাবে গড়ে প্রতি বছর আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি টনের বেশি। অর্থাৎ প্রতি বছর দেশের অতিরিক্ত আলু উৎপাদিত হয়েছে ৩৫ লাখ টনের বেশি। এই অতিরিক্ত উৎপাদনের বিপরীতে রফতানির পরিমাণ সামান্য বললেও কম বলা হয়। রফতানির ক্ষেত্রে এর চেয়ে হতাশার চিত্র আর কী হতে পারে!
আলু বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান বা দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যপণ্য। এ ছাড়া আলু দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি হয়ে থাকে। আলু সবজি হিসেবে, প্রধান বা সহতরকারি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বহুমুখী চাহিদা ও ব্যবহারের কারণে আলুর কদর ক্রমাগত বাড়বে বৈ কমবে না। বাংলাদেশ প্রধান আলু উৎপাদনকারী ১০টি দেশের মধ্যে একটি। আলুর দৈশিক চাহিদাও কম নয়। আবার উৎপাদন সম্ভাবনাও প্রচুর। এখনকার তুলনায় উৎপাদন দু’গুণ-তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। সেটা হলে আলু রফতানিপণ্য হিসেবে সামনের সারিতে উঠে আসবে। কেবল আলু নয়, এমন অনেক কিছুই আছে, যাদের রফতানি সম্ভাবনা অপার। এখানে কাঁঠালের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, কাঁচা-পাকা উভয় ধরনের কাঁঠালেরই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে, কাঁচা কাঁঠালের চাহিদা অতুল্য। ভারত কাঁঠালের বিশ্ববাজার দখলে নিয়েছে। এ থেকে তার আয় ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ সহজেই ঢুকে যেতে পারে এই বাজারে। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশের জমি উদার, উপযোগী ও উৎকৃষ্ট। এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে কাঁঠাল গাছ না জন্মে। বীজ ফেললেই যেখানে গাছ জন্মে, সেখানে কাঁঠালের উৎপাদন বাড়ানো কিংবা কাঁঠাল রফতানি করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কয়েক বছরের মধ্যে কাঁঠাল গাছে ফল আসে এবং এক নাগাড়ে বহু বছর একটি গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। কাঁঠালের বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশেষ নজর দিতে পারে। কাঁঠাল পরিণত হতে পারে তার গুরুত্বপূর্ণ একটি রফতানিপণ্যে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন ফল আমদানিতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়ে যায়। এখানে জন্মায় এমন ফলও আমদানি করতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশি-বিদেশি ফল চাষ বাড়ায় আমদানি কিছুটা কমেছে। ফল চাষ বাড়লে জাতীয় চাহিদা পূরণ করেও বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। আশার কথা, আম উৎপাদন বেড়েছে। আমের নানা ভ্যারাইটি এসেছে। আম এখন উপহার ও রফতানিপণ্যে পরিণত হয়েছে। এক সময় বিদেশ থেকে ফুল আমদানি করতে হয়েছে। এখন দেশে ফুল চাষে বিপ্লব সাধিত হওয়ায় প্রচুর ফুল নানান দেশে রফতানি হচ্ছে। চাষও সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যত্র।
একটি দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য রফতানির বিকল্প নেই। কথায় বলে, রফতানি করো, নয় মরো। আমদানি-রফতানির বিবেচনায় আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর, রফতানিনির্ভর নয়। প্রায় এমন কোনো পণ্য নেই, যা আমরা আমদানি না করি। আর রফতানি করি হাতে গোনা কিছু পণ্য। তৈরি পোশাক প্রধান রফতানিপণ্য। এ ছাড়া আছে পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যসহ আরো কিছু পণ্য, যাদের রফতানির পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আমরা কৃষিজাতপণ্য, ফুল-ফল, শাক-সবজি ও অপ্রচলিত পণ্যাদির উৎপাদন বাড়িয়ে সেগুলোকে রফতানিপণ্যে পরিণত করতে পারি। মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ইত্যাদির উৎপাদন বাড়িয়েও সেটা করতে পারি। বিশ্ববাজারে যে সব পণ্যের চাহিদা আছে, সে সবের খোঁজ খবর নেয়া যেতে পারে। অতঃপর ওইসব পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি করা যেতে পারে। আলু-কাঁঠাল ইত্যাদি যাই হোক না কেন, সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে এবং তা কাজে লাগাতে হবে। খবর বেরিয়েছে, দুটি বড় খাতে আয় কমেছে। রফতানি আয় কমেছে ১৩ মাস পরে। আর সপ্তম মাসেই রেমিট্যান্স কমে হয়েছে সর্বনিম্ন। এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপরই দেশের অর্থনীতি মূলত দাঁড়িয়ে আছে। একে একটি অশনিসংকেত হিসেবে ধরে উভয় খাতে আয় বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান তিন বাধার অন্যতম বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হ্রাস। এ সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে। রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধিই আয় বাড়ানোর উপায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন