জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। কোন ধরণের পূর্বঘোষণা ও প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে ব্যাহত হয় টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং, চিকিৎসা সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের সার্বিক তত্ত¡াবধানে দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কারিগরি টিমের প্রচেষ্টায় ৬ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মূলত যমুনা নদীর এপারের অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ ২টা ৫ মিনিটে একযোগে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়। উত্তরা, গুলশান, বারিধারা, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় আসে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে। ৯টার পর থেকে ধীরে ধীরে আলো ফিরতে থাকে রাতের ঢাকায়। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা। তবে এ ধরণের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কারিগরি টিম দ্রæততার সঙ্গেই সমস্যা সমাধান করেছেন।
বিদ্যুকে খাদ্যের চাইতেও বেশি প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক খসরু চৌধুরী বলেন, আমরা যদি মন্ত্রণালয়ের চিন্তা করি, মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে সজাগ। ইলেকট্রিসিটি আসলে প্রতিটি মানুষেরই দরকার। এটা একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। একটা মানুষের ক্ষুধা যদি লাগে, সে হয়তো এক ঘণ্টার জায়গায় দুই ঘণ্টা বসে থাকতে পারে। কিন্তু ইলেকট্রিসিটি দুই ঘণ্টা বসে থাকার কোন উপায় নেই। এটা খাদ্যের চাইতেও বেশি প্রয়োজনীয়। সমস্যা হয়েছিল মূল গ্রিডে। চারটি বিভাগে। সেটা গতকাল রাতেই সমাধান হয়ে গেছে। দ্রæততার সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান তিনি। দেশে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুিবচ্ছিন্ন ছিল। তারও আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। তখন এতটা দ্রæততার সঙ্গে কাজ করতে পারলেও সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবারের দৃশ্যপট ভিন্ন। দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, নানা কারণেই বিদ্যুতের গ্রিড বসে যেতে পারে। আর সেটি একবার বসে গেলে পুনরায় চালু করার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল এবং দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তবে এ সময় উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিজিসিবি’র নির্বাহী পরিচালক মো. ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বলেন, আল্লাহ সহায়। সাধারণত রিকভার করতে অনেক সময় আবারও বিপর্যয় হয়। অনেকগুলো অপারেশন হয়। সেগুলো অনেকসময় একেবারে নিখুঁতভাবে করা সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়বারও বিপর্যয় আংশিক বিপর্যয় হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। আমরা গতকাল আল্লাহর রহমতে এমন কন্ডিশনে পরিনি। একটু ধীরগতিতে করেছি কিন্তু হোঁচট খাইনি। আর আমাদের গ্রিডের একাংশে পাওয়ার ছিল, সেটাও একটা বিষয়। আর আমাদের কোন লাইনেই কোন পার্মানেন্ট সমস্যা ছিল না। ফলে লাইনগুলোকে চালু করতে পেরেছি। এসব জিনিস আমাদের জন্য সহায়ক ছিল। আর কোন অপারেশনাল ভুলও হয়নি। সবমিলিয়েই একটু তাড়াতাড়ি হয়েছে। আমরা নিজেরাও বুঝেছি। ইতিপূর্বে আমাদের এ কাজে অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মত তার। এছাড়া গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ উদঘাটনে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো, হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের যত ফোর্স ছিল, আমরা মোবিলাইজড করেছি। এছাড়া খুবই সতর্কতার সাথে আস্তে আস্তে প্রতিটি ধাপে ধাপে সাব স্টেশন বাই সাব স্টেশন একটা করে স্টেবল করেছি। কোন ধরণের তাড়াহুড়া করিনি। আমাদের যে টিম রিস্টোরেশনের কাজ করেছে, তাদেরকে কোন ধরণের প্রেশার ক্রিয়েট করিনি। এভাবেই আসলে সম্ভব হয়েছে। এটা আসলে বাংলাদেশের টেকনিক্যাল একটা উন্নতি যে হয়েছে তা বলা যায়। আল্লাহর রহমতে একটা টিম আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি, যারা এরকম একটা সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার ক্ষেত্রে যোগ্য।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা আমাদের ছিল। এটাকে বলা হয় আধুনিকায়ন। এর আওতায় বিপর্যয়ের আগেই আমরা অ্যালার্ম পাবো যে ফল হতে পারে। ঠিক হলে কোন জায়গায় হয়েছে সাথে সাথে আমাদের সিস্টেম আমাদের বলবে, এই জায়গায়। একেবারে ঠিক লোকেশনটা। সেই মর্ডানাইজেশনের কাজ আমরা এখন করছি মাত্র। আরও বছর খানেক পরে একটা সময় আসবে যখন হয়তো অল্টারনেট সোর্স থেকে মানে অন্তত দুটা সোর্স থাকবে। যেন একটা চলে গেলে আরেকটা কাজ করতে পারে। এরকম কাজগুলো এখন আমরা করছি। এ কাজগুলো চলমান। এগুলো হলে আমরা আশা করবো ভবিষ্যতে এমন সিচুয়েশন কম হবে বা হবে না। আর হলেও আমরা আরও দ্রæততার সঙ্গে রেসপন্স করতে পারবো।
একদিন কলকারখানা বন্ধ থাকলে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া এতে রফতানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জণকেও বাধাগ্রস্থ করে। তবে এবারের বিপর্যয়ে তেমনটি দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরি বাবু বলেন, যেকোন গ্রিডে বা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ফল হতেই পারে। তবে এত দ্রæত রিকভারি হওয়া একটা গুড ইফিসিয়েনসি প্রমান করে। আমাদের পিডিবির যে কর্মকর্তারা আছেন, বা পিজিসিবির কর্মকর্তা যারা আছেন অথবা টেকনিশিয়ান, ম্যানেজমেন্টে যারা আছেন, এছাড়া মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ সকলের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখানে ছিল। জনগণ খুব কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ ফিরে পেয়েছে।###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন