অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস বেশি বয়সি মানুষকে আক্রান্ত করলেও ডায়াবেটিস যে কোন বয়সে হতে পারে। শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রবনতা বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে শিশু-কিশোর ডায়াবেটিস। আর যেহেতু আক্রান্ত শিশুরা জীবনের একটি বড় সময়জুড়ে রক্তে শর্করার আধিক্যে ভোগে, পরিণত বয়সে এদের হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, অন্ধত্ব বা পা হারানোর মতো জটিলতার আশঙ্কাও অনেক বেশি থাকে। ফলে একটি শিশুর ডায়াবেটিস হওয়া মানে একটি সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস কেন হয়?
অনেক ক্ষেত্রে কম বয়সে ও শিশু বয়সে যে ডায়াবেটিস হয়, তা টাইপ-১ ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। জন্ম ও পরিবেশগত নানা কারণে এই ডায়াবেটিস হয়। এতে এক ধরনের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) জটিলতায় দেহের অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো দ্রæত ধ্বংস হয়ে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বাকি জীবন তাকে ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয়। তবে বাংলাদেশে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ অনেক কম।
তবে বড়দের মধ্যে দেখা যাওয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিসও বর্তমানে কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন ইত্যাদি দেশসমুহ কম বয়সে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইদানীং ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা অত্যধিক হারে বেড়েছে, বেড়েছে ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় ও জাংক ফুডের প্রতি আসক্তি। সমানতালে কমছে খেলাধুলার বা কায়িক শ্রমের সুযোগ। কম্পিউটার বা টেলিভিশনের সামনে বসে সময় কাটানোর অভ্যাসও ওজন বাড়ার জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে যে রোগ হওয়ার কথা চল্লিশ বছরে বা তারও পরে, সেই রোগে কৈশোর বা তারুণ্যেই আক্রান্ত হচ্ছে এরা। ওজনাধিক্য ও স্থূল মেয়েশিশুরা কৈশোরে ডায়াবেটিসের সঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম নামের আরেক ধরনের জটিল সমস্যায়। অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে মাতৃগর্ভে অপুষ্টি ও কম ওজনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া জন্মগত কিছু রোগ এবং হরমোনজনিত কিছু সমস্যায় অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। কিছু তরুণ-তরুণী অগ্ন্যাশয়ে পাথর হওয়ার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফাইব্রো ক্যালকুলাস প্যানক্রিয়েটিক ডিজিজ নামে পরিচিত। তাই শিশু-কিশোর বয়সে ডায়াবেটিস বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হতে পারে।
শিশুদের ডায়াবেটিস চিকিৎসা:
এখন পর্যন্ত ইনসুলিনই শিশুদের উপযোগী একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ চিকিৎসা। যদিও কৈশোরে (১০ বছর বয়সের ওপর) ওজনাধিক্য বা স্থূল টাইপ-২ ডায়াবেটিক শিশুকে মেটফরমিন ওষুধ দিয়েও চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় জীবনযাত্রা ও মন-মানসিকতা; এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলবে রোগীর চিকিৎসা। শিশুদের চিকিৎসায় অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রতিবেশী এমনকি বন্ধুবান্ধবদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটি বিশেষ বয়সের পর ধীরে ধীরে ইনসুলিন ব্যবহার, রক্তে শর্করা পরিমাপ করা, নিজের সমস্যা ও জটিলতা দ্রæত শনাক্ত করার দক্ষতা অর্জন করতে শিশু-কিশোরদের পর্যায়ক্রমে শিক্ষিত করে তুলতে হয়। শিশুর সঠিক, পরিমিত ও সময়ানুবর্তী খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, খেলাধুলাসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা এবং বিপদ চিনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারার প্রশিক্ষণ- এ সবই চিকিৎসার আওতায় পড়ে। ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা। তাই এ রোগে মানসিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও বেশি। শিশু-কিশোরদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, ইতিবাচক আচরণ ও সহানুভূতিশীল মনোভাব ছাড়া তাই তাদের এ অবস্থায় পূর্ণ বিকাশ অসম্ভব।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে:
বিজ্ঞানীদের মতে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৭০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। আর তার জন্য চাই জীবনযাপনে ও অভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন। আজকে যে শিশু বা কিশোর, তার ভবিষ্যৎকে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ করে তুলতে এই পরিবর্তন এখনই আনতে হবে। শৈশবে যারা ওজনাধিক্য ও স্থূলতায় ভোগে, তাদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। সঠিক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সচেতন করে তুলতে হবে। বর্জন করতে হবে ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর খাবার ও টিফিনে তাদের অভ্যস্ত করুন, প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবারের প্রতি উৎসাহী করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে খেলাধুলা বা কায়িক শ্রম করা জরুরি। স্কুলে, পাড়ায়, শহরের আবাসিক এলাকায় খোলা মাঠ ও পার্ক বা শিশুদের খেলার জায়গার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এসেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার তাগিদ থেকেই এটা আমাদের করতে হবে।
সহযোগী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন