বায় দূষন বলতেআমরা সহজে যা বুঝি তা হলো, ‘পরিবেশের উপাদানসমূহের মধ্যে ক্ষতিকারক বা বিষাক্ত প্রভাব রয়েছে এমন এক বা একাধিক পদার্থের বাতাসে মাত্রাতিরিক্তি উপস্থিতি।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘বায়ুদূষণ হলো, যেকোনো রাসায়নিক, শারীরিক বা জৈবিক এজেন্ট দ্বারা অভ্যন্তরীণ বা বাইরের পরিবেশকে দূষিত করা, যা বায়ুমণ্ডলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করে এবং পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থাকে বিঘ্নিত করে।’ বায়ুমণ্ডলে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ গ্যাস রয়েছে। এই গ্যাসগুলির গঠন বৃদ্ধি বা হ্রাস জীবকুলের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিকারক। বায়ুদূষণ রোধ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতে (এসডিজি) বায়ুর গুণমান ব্যবস্থাপনার ৩ নম্বর ও ১১ নম্বর লক্ষ্যে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। বায়ুমান ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে পরিষ্কার বায়ু নিশ্চিত করে সর্বোত্তম ফলাফল অর্জন করা যেতে পারে। সেটি না হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।
বায়ুদূষনের কারণ সমূহ: বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা পরিষদের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ৫৮% উৎস ঢাকার উপকণ্ঠে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটের ভাটা দায়ী। এছাড়া ১৫.৩ % ধূলাবালি, ১০.৪% গাড়ির ধোঁয়া, ৭.৬% লেড (সীসা), ৭.৪% জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস), ১.৩ সামুদ্রিক লবণ দায়ী। এছাড়া শিল্পকারখানা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনঘন রাস্তা খনন, ড্রেনের ময়লা রাস্তায় পাশে উঠিয়ে রাখা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই দূষিত করছে বায়ুকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞদের পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, রাজধানীতে বেবি-ট্যাক্সি, টেম্পো, মিনি-ট্রাক, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিনযুক্ত ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে অন্তত ৫ লাখ ৪০ হাজার ৭৭টি। আরো জানা যায়, প্রায় এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে ৫৯ হাজার ৪৮টি। ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় প্রতিদিনই ত্রুটিপূর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন এসব যানবাহন কালো ধোঁয়া নির্গত করে। পেট্রোল ও ডিজেল ব্যবহার করা যানবাহন কালো ধোঁয়া কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার উপকণ্ঠে ট্যানারিগুলো থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস, ক্লোরিন ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস নির্গত করে এবং কিছু অন্যান্য অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যা নগরবাসীর কাছে নিরব ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। বিশেষ করে, শিল্প এলাকা এবং বাণিজ্যিক এলাকা আবাসিক এলাকার তুলনায় বেশি দূষিত হয়। তবে কিছুকিছু আবাসিক এলাকা শিল্প এলাকার মতই দূষিত। এরমধ্যে রয়েছে মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, তেজগাঁও, মহাখালী, গাবতলী, মিরপুর, বনশ্রী প্রভৃতি ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। সাধারণত, বায়ুমান ৪০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার অনুমোদিত সীমা হলেও এসব এলাকার বায়ুমান কোন কোন সময় ৩,০০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার পর্যন্ত দেখা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণের ধারা: গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টায় ঢাকার বাতাসে তিনটি স্থানে যে দূষণ দেখা গেছে তা ‘মডারেট’ বা মোটামুটি, তবে এটি খারাপের দিকে। তিনটি স্থানের বায়ুমান সূচক (একিউআই) হলো- গুলশান ১ (আমেরিকান এম্বাসি) ৮৮, নিকেতন ৫০ এবং পুরান ঢাকা ৯৯ (আজিমপুরের কাছাকাছি)। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, একই সময়ে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একিউআই মান ছিল ১৬৩। শিল্প এলাকা হওয়ায় এর মান ৩০০ ও অতিক্রম করে।একিউআই এর ধারা থেকে দেখা যায়, বিকেলে থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সর্বোচ্চ থাকে। এরপর ধীরেধীরে কমে যায়। সকাল ৯টা থেকে আবার বায়ু দূষিত হওয়া শুরু হয়। চলতি বছরের ৩ আগস্ট একটি ইংরেজি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের দিক থেকে ৪র্থ অবস্থানে আছে। চিলির সান্তিয়াগো, পাকিস্তানের লাহোর, সৌদি আরবের রিয়াদ প্রথম তিন স্থান দখল করেছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, ওইদিন সকাল ১০টার দিকে ঢাকার বাতাসের মান সূচক (অছও) ১৫৪ এ রেকর্ড করা হয়েছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এর মতে, ১০১ এবং ২০০ এর মধ্যে একিউআইকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়, যা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য হুমকি। একইভাবে, ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘খারাপ’ বলা হয়, যেখানে ৩০১ থেকে ৪০০-এর স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। যখন ৩০১ থেকে ৪০০ এর রিডিং ‘বিপজ্জনক’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: প্রতিনিয়তই বায়ু অমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দূষণের চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দূষণজনিত কারণে আহত বা নিহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলির প্রায় ৯৮ শতাংশ শহরগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ু মানের নির্দেশিকাগুলি পূরণ করে না। যেখানে উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে এই শতাংশটি ৫৬ শতাংশে স্থির থাকে। বিশ^ব্যাপী ১০৩টি দেশের ৩,০০০টি শহরের বায়ু মানের মানের উপর করা একটি সমীক্ষায় বাংলাদেশের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা এবং সিলেটের মতো কয়েকটি প্রধান শহর তালিকার শীর্ষে স্থান পেয়েছে। সাধারণভাবে, এই শহরগুলির বায়ুর মান জনস্বাস্থ্যের উপর উচ্চ প্রভাব ফেলে। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার,ব্রংকাইটিস, যক্ষ, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা, গর্ভবতী মায়েদের ওপর প্রভাব, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়া ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগ হয়। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয় জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয় এবং প্রায় ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) মানুষ প্রতি বছর, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি-এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার।
বায়ুদূষণ রোধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে: সম্প্রতি সম্পন্ন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পেিরবশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মল্লিক আকরাম হোসেনের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম ঢাকা শহরের মেট্রোরেল নির্মাণে পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এত ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোদের জন্য বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলার মতো নানা ব্যবস্থা নিতে হবে। কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। উন্নত জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি, এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার কমানো, সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০% দূষণ কমানো সম্ভব। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বায়ুদূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নিয়মিতভাবে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে। মূলধারার যানবাহনকে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় রুপাস্তর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তিগত যানবাহনে নিরুৎসাহিত করণ এবং এবং গণপরিবহণে উৎসাহিত করতে হবে। গৃহস্থালীর বর্জ্য পোড়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, আইন প্রনয়ন ও প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব।
লেখকদ্বয়ঃ প্রাবন্ধিক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন