মহান আল্লাহতা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘কুল বিফদলিল্লাহি ওয়াবিরাহমাতিহি ফবেজালিকা ফালয়াফরাহু হুয়া খায়রুম মিম্মা ইয়াযমাউন।’ (পারা ১১ রুকু ১১)। অর্থাৎ, হে প্রিয় হাবীব আপনি বলে দিন, তারা যেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করে। উক্ত খুশি ও আনন্দ তাদের সমুদয় সঞ্চয় থেকে অতি উত্তম। প্রিয়নবী যে সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য রহমত স্বরূপ, এতে কোনো দ্বিমত নেই। তাই তাঁর জন্মদিনে আনন্দ করা, খুশির প্রকাশ ঘটানো মোটেই দোষের নয়। বরং তাঁর গুণগান শান মান মর্যাদা ও মাহাত্ম্য স্মরণ করা ও আলোচনা করা বিধাতার আনুগত্যের নামান্তর।
হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় রাসুল (সা.) এর কাছে সোমবার দিবসে রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে প্রিয়নবী এরশাদ করেন, ‘ফিহী উলিদতু ওয়াফিহী উনযিলা আলাইয়্যা।’ অর্থাৎ এ দিনেই আমি আবির্ভূত হয়েছি এবং এদিনেই আমার উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (মিশ্কাত শরীফ ১৭৯ পৃষ্ঠা)। উপরোক্ত হাদিস থেকে মিলাদুন্নবী (সা.) তথা প্রিয়নবীর জন্মদিবস ও নুযুলে কুরআন দিবসের গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিবসের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন ও নেয়ামত প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা পালনের বৈধতা প্রমাণিত হয়। সুতরাং সপ্তাহের প্রতি সোমবার যেমন মুসলমানদের নিকট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রাখে, তেমনি বার্ষিক হিসেবে ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব মুসলমানদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ এবং এ মাসে এ দিবসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অপরিসীম। ২৭ রমজান পবিত্র কুরআন অবতরনের দিন হিসেবে যেভাবে গোটা রমজান মাস সম্মানিত স্মরণীয় বরণীয়, তেমনিভাবে প্রিয়নবীর বেলাদত দিবস ১২ রবিউল আউয়াল গোটা মাসের মর্যাদা সমুন্নত করেছে। মুসলিম মিল্লাতের কাছে ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত এবং এ মাসের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ওলামায়ে ইসলামের সর্বসম্মতিক্রমে। প্রসঙ্গত বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ কুস্তালানী মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেন যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.) এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ওলামায়ে কেরাম বলেন, প্রিয় নবীর জন্মদিবস শবে ক্বদর থেকে উত্তম। আরো বলেন, শুক্রবার আদম (আ.) এর জন্ম দিবস হওয়ার কারণে যদি সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনস্বীকৃত হয় তাহলে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর জন্মদিবসের মর্যাদা কেমন হতে পারে? তাঁর মর্যাদার যথার্থ বর্ণনা আদৌ কি সম্ভব? (জুরকানী শরহে মাওয়াহিব পৃ. ১৩২-১৩৫ মাদারেজুন্নবুয়ত ২য় খন্ড ১৩ পৃষ্ঠা)।
ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দ। মিলাদ অর্থ জন্মদিন, জন্মকাল, জন্মস্থান, জম্মোৎসব, ইত্যাদি। ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ অদৃশ্যের সংবাদদাতা আল্লাহর প্রেরিত বান্দা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভাগমন উপলক্ষে শরয়ী পন্থায় খুশি, আনন্দ উদযাপন করা। এ উপলক্ষে নবীজির জন্মকালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর বর্ণনা করা, তাঁর বাল্যজীবন, শৈশব জীবন, কিশোর জীবন, মক্কী জীবন, মদনী জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, হিজরত, জিহাদ, ইসলামী দাওয়াত প্রচার সম্প্রসারণ, সার্বিক বিষয়াদির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করার নামই মীলাদুন্নবী (সা.)। এক শ্রেণির লোকেরা প্রচার করে থাকে ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দুই ঈদ ছাড়া তৃতীয় কোনো ঈদের অস্তিত্ব নেই। এ দাবি ভিত্তিহীন। ঈসা (আ.) এর উপর আসমান থেকে খাবার ভর্তি দস্তরখানা অবতীর্ণ হওয়ার দিন, আরাফাতের দিন, শুক্রবার জুমার দিনসহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত প্রাপ্তির দিনসমূহকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করার বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, ‘ইবনে মরিয়ম বলেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রভূ আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। এটা হবে আমাদের পূর্ববতী ও পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ স্বরূপ।’ (সূরা: আল মায়িদা, আয়াত: ১১৪)। আসমান থেকে খাদ্য অবরতণের দিবস যদি ঈদের দিবস হয়। তবে যে দিন সমগ্র সৃষ্টির মূল ধরাধামে তাশরীফ এনেছেন সে দিন কেনই বা ঈদের দিবস হবে না? ঈদে মীলাদুন্নবী হিসেবে এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতইনা গুরুত্ববহ কতইনা আনন্দের।
মহীয়ান স্রষ্টা বিশ্ববাসীর প্রতি তাঁর প্রিয় হাবীব রাহ্মাতুল্লীল আলামীনের প্রেরণকে মহান আল্লাহর সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত বলে অভিহিত করেছেন, এরশাদ করেছেন, ‘লাক্বাদ মান্নাল্লাহু আলাল মুমিনীনা ইয বাআছা ফিহীম রাসুলাম মিন আনফুছিহীম।’ (সূরা: ৩, আলে ইমরান, পারা ৪, আয়াত: ১৬৪)। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমীনদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন, যেহেতু তিনি তাদের মধ্যে তাদেরই কল্যাণ্যার্থে একজন সম্মানিত রসুল প্রেরণ করেছেন। ঈমানদারদের উপর সর্বোত্তম নিয়ামত প্রেরণ করে তাদেরকে ধন্য ও কৃতার্থ করেছেন। সুতরাং ঈমানদার মাত্রই সকলের উপর এ নিয়ামতের যথার্থ মূল্যায়ন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অবশ্যই কর্তব্য। বিশেষত যে মাসে যে দিনে এ মহান অনুগ্রহ দান করেছেন, সে মাসে সেদিনে এ নিয়ামতের আলোচনা করা স্রষ্টার নির্দেশেরই অনুগামিতা। আল্লাহপাক কুরআন শরীফের বহুস্থানে খোদাপ্রদত্ত নিয়ামতের আলোচনা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং বিভিন্নভাবে এ নিয়ামতের যথার্থ স্মরণ করার নির্দেশ করেছেন। বিশেষত সুরা দোহায় এরশাদ করেছেন, ‘ওয়াম্মা বেনেমাতী রব্বীকা ফাহাদ্দিস’ অর্থাৎ আপনার পালন কর্তার নিয়ামতের র্চচা করুন। (পারা-৩০ রুকু ১৮)।
অতঃপর আল্লাহপাক নিয়ামতের অবমূল্যায়ন ও অস্বীকারকারীদের পরিণতি সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, ‘আলাম ত্বারা ইলাল্লাযিনা বাদ্দালু নিআমাতাল্লাহে কুফরান’ অর্থাৎ আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা অকৃতজ্ঞ হয়ে আল্লাহর নিয়ামতকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।’ (পারা ১৩ রুকু ১৭)।
মিলাদুন্নবী (সা.) ইসলামী ঐক্যের প্রতীক, ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক। ইসলামী সংস্কৃতির এক গৌরবময় ও বরকতময় আমল, হাজার বছর ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে এ ধারা আবহমান কাল থেকে প্রচলিত। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম ইবনে জওযী (৫১০-৫৭৯হি.) বর্ণনা করেন, সর্বদা মক্কা-মদীনায়, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া, এমনকি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র আরববাসী মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল আয়োজন করে আসছেন, রবিউল আউয়ালের নবচন্দ্র উদিত হলে তারা খুশি, আনন্দে উদ্বেলিত হয় এবং বিশেষ গুরুত্বসহকারে মিলাদ পাঠ ও শ্রবণের ব্যবস্থা করে থাকে। এতে তাঁরা অসংখ্য সওয়াব ও মহাসাফল্য অর্জন করে থাকে। (আল্লামা ইমাম ইবনে জওযী ৫৭৯হি. কর্তৃক বিরচিত মিলাদুন্নবী)
লেখক: অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন