পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, মুসলমানগণ আল্লাহর ফযল ও রহমত পাওয়ার কারণে যেন নির্মল খুশি ও আনন্দোৎসব করে। এটা তাদের যাবতীয় সঞ্চিত সম্পদ থেকে উত্তম।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুফাস্সির হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ফযল ও রহমত দ্বারা নবী করিম (সা.)-ই উদ্দেশ্য। সুতরাং নেয়ামতপ্রাপ্তি উপলক্ষে শুকরিয়া আদায়ের জন্য বিভিন্ন বৈধ অনুষ্ঠান করা কোরআনের নির্দেশ। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী, সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৮) রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় বেলাদত দিবসের ব্যাপারে খুব খুশি ছিলেন এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার জন্ম হয়েছে, আমি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার ওপর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ রোযা রাখা অন্যতম ইবাদত। সুতরাং যে কোনো ধরনের ইবাদত করে এই দিনকে উদযাপন করা যায়। কেউ রোযা রাখতেও পারে, আবার মিলাদের মাহফিল (নবীজির জীবনী আলোচনা) করতেও পারেন। তিনি জন্মদিন উপলক্ষে রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করতেন। সুতরাং আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করা রাসূলুল্লাহর সুন্নাত।
আনন্দিত হওয়ার সুফল: ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) ইমাম সুহাইলী থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি যে, সে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। অতঃপর সে বলল, তোমাদের ছেড়ে আসার পর আমি কোনো শান্তি পাইনি; তবে প্রতি সোমবার আমার শাস্তি কিছুটা কমানো হয়। (ইমাম সুহাইলি বলেন) কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.) সোমবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন আর আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবা রাসূলুল্লাহর জন্মগ্রহণের সুসংবাদ আবু লাহাবকে দিলে সে তাকে আনন্দিত হয়ে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনুয জাযরী ও শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহ.) বলেন, এ হাদিস ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকারী এবং এর জন্য সম্পদ ব্যয়কারীদের প্রতিদান প্রাপ্তির প্রমাণ। আবু লাহাব, যার নিন্দায় কুরআনের একটি সূরা (লাহাব) অবতীর্ণ হয়েছে, সে যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের ওপর খুশি হয়ে তার দাসী (সুয়াইবা)কে স্বাধীন করে দেয়ার কারণে শাস্তি কম ভোগ করে, তাহলে সে মুসলিমের কী অবস্থা হবে, যে রাসূলুল্লাহর ভালবাসা নিয়ে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করে এবং ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনে সম্পদ ব্যায় করে? তবে মন্দ বিদয়াত যেমন নাচ, গান, হারাম বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত; কেননা এগুলোর কারণে (মিলাদুন্নবী উদযাপনের) বরকত পাওয়া যাবে না।’
পানাহারের আয়োজন করা যাবে কি? হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবুয়ত প্রকাশের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই নিজের আক্বীক্বা করেছেন। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়ূতী (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দাদা আবদুল মুত্তালিব নবীজির জন্মের সপ্তম দিনে রাসূলুল্লাহর আকিকা করেছেন। অথচ, আক্বীক্বা দু’বার হয় না। সুতরাং রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বিতীয়বার যে আক্বীক্বা করেছেন, তা ছিল আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ এবং উম্মতের কাছে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে নিজের ওপর দরুদ শরীফও পাঠ করতেন। অতএব, রাসূলুল্লাহর জন্ম উপলক্ষে মুসলিম ভাইদের একত্রিত করার মাধ্যমে খানা খাওয়ানো, অন্যান্য ইবাদত পালন এবং ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্যও মুস্তাহাব।
নবী-সাহাবী মিলাদুন্নবী পালন করেছেন কী?: ১. নবী করিম (সা.) নবুয়ত পরবর্তীকালে নিজেই সাহাবীদেরকে নিয়ে নিজের মিলাদ সম্পর্কে আলোকপাত (তথা মিলাদুন্নবীর মাহফিল) করেছেন। হযরত ইরবায ইবনে ছারিয়া (রা.) একদিন হুযূর (সা.)কে তাঁর মিলাদ তথা আদি বৃত্তান্ত বর্ণনা করার জন্য আরয করলে রাসূলে করিম (সা.) এর ইরশাদ করেন, ‘আমি তখনও নবী ছিলাম, যখন আদম (আ.) এর দেহের উপাদানÑ মাটি ও পানি পৃথক পৃথক অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ আদম (আ.) এর সৃষ্টির পূর্বেই আমি নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। আমাকে হযরত ইবরাহীম (আ.) দোয়ার বরকতে তাঁর বংশে প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং আমি তাঁর দোয়ার ফসল। হযরত ঈসা (আ.) তাঁর উম্মতের নিকট আমার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই আমার সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। আমার জননী বিবি আমেনা আমার প্রসবকালীন সময়ে যে নূর তাঁর গর্ভ হতে প্রকাশ পেয়ে সুদূর সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত করতে দেখেছিলেন, আমিই সেই নূর। ২. একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নিজগৃহে মিলাদ মাহফিল (তথা মিলাদুন্নবীর মাহফিল) অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন। উপস্থিত সাহাবাগণের নিকট নবী করিম (সা.) এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত ঘটনাবলী বর্ণনা করছিলেন। শ্রোতামন্ডলী শুনতে শুনতে মিলাদুন্নবীর আনন্দ উপভোগ করছিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজির দরুদ পড়ছিলেন। এমন সময় রাসূলে করিম (সা.) সেখানে উপস্থিত হয়ে ইরশাদ করলেন, ‘তোমাদের সকলের প্রতি আমার সুপারিশ ও শাফাআত অবধারিত হয়ে গেল।’ সুবহানাল্লাহ! ৩. সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবী করীম (সা.) এর উপস্থিতিতে তাঁর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন এবং অন্যান্য সাহাবীগণ সমবেত হয়ে তা শ্রবণ করতেন, যা শুনে মুগ্ধ হয়ে নবীজি তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন।
মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী: মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী হলো ব্যাপক আলোচিত শব্দ। শাব্দিক অর্থে মিলাদুন্নবী দ্বারা নবী করীম (সা.) এর শুভাগমন এবং সিরাতুন্নবী দ্বারা রাসূল (সা.) এর চরিত্র বুঝালেও ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় উভয় শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। ইমাম নাসাফী (রহ.) বলেন, জিহাদ তথা যুদ্ধের কর্ম পদ্ধতির নাম হলো সিরাত। তাই সিরাতুন্নবী নবী করীম (সা.) এর ৮ বছরের যুদ্ধ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত; নবীজির জিহাদী জিন্দেগীর অংশের নাম। (হিদায়া; কাওয়াঈদুল ফিকহ)। পক্ষান্তরে মিলাদুন্নবী হলো রাসূলুল্লাহর আদি বৃত্তান্তের নাম। নবী করীম (সা.) এর নূরী জগতের সৃষ্টি হতে শুরু করে নূরানী জগতে লক্ষ লক্ষ বছর বিচরণ, তারপর দুনিয়ার বুকে শুভাগমন ও দুধপান করার অবস্থা থেকে ৬৩ বছর নূরানী জাহেরি হায়াতে তৈয়্যবার প্রতিটি বিষয় আলোচনায় স্থান পায় মিলাদুন্নবীর মাহফিলে বা অনুষ্ঠানে। যুগ যুগ ধরে বিশ্বের মুসলমানগণ রবিউল আওয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে নবীজির শুভাগমনকে অতি ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছেন। ইসলামী শরীয়তের মুফতিগণ বিশেষত মক্কা-মদীনার ৯০ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম ১২৮৬ হিজরীতে এটাকে বরকতময় ও মুস্তাহাব হিসেবে চূড়ান্ত ফায়সালা দিয়ে এই ফতোয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রেরণ করেছেন: ‘হে মুসলমানগণ! আপনারা জেনে রাখুন যে, মিলাদুন্নবী (সা.) এর আলোচনা ও তাঁর সমস্ত শান-মান বর্ণনা করা এবং ঐ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া সবই সুন্নাত, যা প্রকৃত ওলামায়ে কেরাম ও আউলিয়া কেরামের অনুসৃত তরিকা।’ বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশে এ দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)কে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করছে।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন