এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার পর সামনে রয়েছে এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা। এখন শিক্ষাবর্ষের শেষ পর্যায়। সামনে স্কুল-মাদরাসার সকল শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাও রয়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীরা বড় রকমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বিদ্যুতের অভাবে ভালোমতো লেখাপড়া করতে পারেনি। এ নিয়ে তাদের ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ও ভোগান্তি হয়েছে অশেষ। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির সহসা উন্নতি ঘটবে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে সামনের বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা এবং তাদের অভিভাবকরা যারপর নাই শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এখনো বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যহত হচ্ছে। আগামীতে লোডশেডিং বাড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি আরো বেশি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লক্ষ কোটি শিক্ষার্থীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ক্ষতির আশঙ্কাকে মোটেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শুধু শিক্ষার্থী-অভিভাবকই নয়, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে দৈনন্দিন জীবন, শিল্প ও কৃষির উৎপাদনসহ সকল ক্ষেত্র অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে। আজকের দিনে সচ্ছন্দ জীবনযাপন, শিল্প ও কৃষির উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি- সব কিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। গত ৪ অক্টোবর ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেশের অর্ধাংশ দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে ডুবে থাকার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অপরিসীম বিভ্রাট ও ক্ষতি হয়েছে, সেটাই প্রমাণ করে বিদ্যুৎ কতটা অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয়। ‘দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এমন অনেক লম্বা লম্বা কথা দেশবাসী শুনেছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে বিদ্যুতের এই ফোলানো বেলুন যে এমনভাবে ফুটো হয়ে চুপসে যাবে, তা কেউ ধারণাও করতে পারেনি। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দাবি, বিদ্যুতে স্বয়ংভরতা সরকারের একটি বড় সাফল্য। অথচ, সেটাই তার ব্যর্থতার উল্লেখযোগ্য নজির হিসেবে এখন পরিগণিত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সংকট মোচনের সম্ভাবনা আপাতত নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন শীতেও সংকট থাকবে। পরেও অনেক দিন সংকট প্রলম্বিত হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহ সংকট ও মূল্যÑ দুই-ই বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও সংকটে পতিত হয়, যা ক্রমাগত বাড়ছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। এতে ধাক্কাটা আমাদের ওপর বেশিই পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপসহ লোডশেডিংয়ের ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের পর আর লোডশেডিং থাকবে না। তার কথা সত্য হয়নি। বরং ক্রমাগত লোডশেডিং বেড়েছে, এখনো বাড়ছে। এখন আবার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ব্যাপক ঘাটতিজনিত কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বজায় রাখাই কঠিন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গ্রিড বিপর্যয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডিজেল-ফার্নেস অয়েল ইত্যাদি জ্বালানি তেলের ওপর চাপ বেড়ে যায়। এদের কোনো কোনোটির ব্যবহার শতভাগ ছাড়িয়ে যায়। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় জেনারেটর চালাতে জ্বালানি তেলের ব্যবহারও বেড়ে গেছে। এতে ডিজেল, ফার্নেস অয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলেরই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দ্রুত ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন তো বটেই জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন ও অন্যান্য কাজ চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়বে। ওদিকে দেশের ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে আহরিত গ্যাসে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এলএনজি আমদানি করতে হয়। এখন এলএনজি আমদানি করেও সরকার ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। এ মুহূর্তে গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ দৈনিক ৬০০ এসএফসি। দেশের মোট বিদ্যুতের ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ আসে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে, আর ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এখন একই সঙ্গে তেল ও বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটা সচল রাখা সম্ভব হবে, সেটা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আরো একটি সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ কেনে, তার পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। প্রতিমাসে এই খাতে সরকারের ব্যয় হয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত প্রায় ৫ মাস এই টাকা সরকার দিতে পারছে না। অনেকের আশঙ্কা, সরকারের অপারগতায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সংকট ব্যাপক দুর্দশা ও ক্ষতির কারণে পরিণত হবে।
বিদ্যুতের সঙ্গে আমাদের জীবনধারা, উৎপাদন, উন্নয়ন ইত্যাদি অবিচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করার পরও এখন বিদ্যুৎ নেই কেন? সরকারের লোকেরা বিদ্যুৎ নিয়ে আগের সরকারকে উঠতে-বসতে গাল-মন্দ করে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি এরূপ যে, আগের সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ যেখানে রেখে গিয়েছিল, এখন পরিস্থিতি সেখানেই ফিরে গেছে। এটা বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের শোচনীয় ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়। দেশের মানুষ বিদ্যুৎ চায়। সরকার বিদ্যুৎ কোথায় পাবে, সেটা তাদের জানার বিষয় নয়। জ্বালানি তেল নেই, গ্যাস নেই, টাকা নেইÑ এসব কথাও তারা শুনতে নারাজ। বিদ্যুৎ দিতে হবে, এটাই সাফকথা, শেষকথা। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার যথেচ্ছভাবে গ্রাহকদের পকেট কেটেছে। ফের বড় আকারে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সরকারকে গ্রাহকের ‘কামধেনু’ ভাবার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। মানুষের নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন