রাজধানীসহ সারা দেশে নিখোঁজের ঘটনা বাড়ছে। হঠাৎ করে এভাবে নিখোঁজের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। যারা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, তারা স্বেচ্ছায় কোথাও চলে যাচ্ছে, নাকি আত্মগোপন করে থাকছে, নাকি কেউ তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কেউই বলতে পারছে না। গত ক’দিনে এই যে ১০/১২ জন লোক হারিয়ে গেল, তারা তাহলে কোথায় গেল? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছে না। আরো এক উদ্বেগজনক খবর হলো, একই সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাও বাড়ছে। খবর অনুযায়ী, নয় দিনে ১৬ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়াতে জনমনে ভীতি-আতঙ্ক বিস্তার লাভ করছে। গুম, নিখোঁজ বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন না হলেও মাঝখানে এসব কিছুটা কমে গিয়েছিল, যা ছিল বড় রকমের একটা স্বস্তির কারণ। সেই স্বস্তিতে ফের ফাটল দেখা দিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, বিগত ৯ বছর ৭ মাসে ৪৫৭ জন নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৩৩২ জনের কোনো খোঁজ আজ অবধি মেলেনি। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে নিখোঁজ হয়েছে ৬০ জন, যাদের মধ্যে ৩২ জনের হদিস মেলেনি। বাকি ২৮ জনের মধ্যে ৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ৩ জন ফিরে এসেছে এবং ১৮ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখিয়েছে। অধিকাংশ নিখোঁজের ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে যে, তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় নিখোঁজ বা তুলে নিয়ে যাওয়াÑ যা কিছুই হোক না কেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব তাদের খুঁজে বের করা। সে কাজটি খুব কমই হয়েছে। নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জানানোর পরও তদন্ত-তালাশের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কথিত বন্দুকযুদ্ধের ব্যাপারেও অভিযোগ কম নেই। প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেয়া হয় তা একই রকম এবং ব্যতিক্রমহীন। মানুষ এসব ‘কাহিনী’ এখন আর বিশ্বাস করতে চায় না। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি পরে বন্দুকযুদ্ধের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ১ জন করে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। গত ১১ মাসে নিহত হয়েছে ১৮৪ জন। গত বছর একই সময় নিহত হয় ১৭১ জন এবং ২০১৪ সালে নিহত হয় সর্বমোট ২৫৪ জন। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-’ হিসেবে অভিহিত করে এ ধরনের হত্যাকা-ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তা বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা কমেনি। যে যত বড় অপরাধীই হোক, বিনাবিচারে তাকে হত্যা করার কোনো অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। এটা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হয় যে, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ যেমন কমেছে, একই সঙ্গে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গুম, নিখোঁজ, খুন-খারাবি, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নাগরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেমন মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে, তেমনি তা দেশের ভাব-মর্যাদাকেও অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা যখন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নাজুক চিত্র তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে, সমালোচনা করে, মানবাধিকার সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানায় তখন আমাদের জাতীয় মর্যাদা আর সম্মানজনক অবস্থানে থাকে না। সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত। যে কোনো দিকের বিবেচনায় নাগরিক নিরাপত্তা, বিচারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এটা সরকারকেই করতে হবে। এখন নিখোঁজ নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে জনমনে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তা দূর করতে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন