তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন গত ৯ অক্টোবর। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ভারতের দীর্ঘদিনের আশ্বাসের আর বাংলাদেশের অনুনয়-বিনয় করার ইতি ঘটতে চলেছে। ভারত তার চাহিদার সব কিছুই বাংলাদেশ থেকে পেলেও এ দেশের কোনো ন্যায্য দাবিই পূরণ করেনি। তিস্তার পানিচুক্তি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছে! এই হলো রক্তের বন্ধনের নমুনা। অথচ, আন্তর্জাতিক নদী-তিস্তার পানির অভাবে এই নদী সংশ্লিষ্ট ও কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের মানুষের কৃষি খাত ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছে। উপরন্তু অঞ্চলটি প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে বর্ষার সময়ে ভারত তার অঞ্চলকে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গজলডোবা বাঁধের সব গেট একবারে খুলে দেয়। তাতে এপারের সব কিছু অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। এমন সর্বনাশা কর্মের পরও আমরা অবলীলাক্রমে ভারতের সব চাহিদা পূরণ করে দিয়েছি। বিনিময়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। এমন একতরফা বেনিফিট বা সুবিধা বিশ্বে বিরল। স্মরণীয় যে, তিস্তার পানি চুক্তির খসড়া চূড়ান্তের পরও ২০১২ সাল থেকে তা আটকে রয়েছে। ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তি করার কথা থাকলেও ভারত অভ্যন্তরণী কারণ দেখিয়ে সে চুক্তি করেনি। তখন থেকে ঝুলে রয়েছে তিস্তা চুক্তি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন গত ৩০ মে গুয়াহাটিতে এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, ভারতের সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি ১১ বছর ধরে ঝুলে আছে, যা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ এবং ‘লজ্জাজনক’। তবুও গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা চুক্তির কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে দু’দেশের অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির কথা বলা হয়েছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা চুক্তিকে কম গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর সমস্যার সাথে একত্র করা হয়েছে। ফলে তিস্তার পানি চুক্তির গুরুত্ব ম্লান হয়ে গেছে! সর্বোপরি সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার বারংবার ঘোষণা দেওয়ার পরও উক্ত কুকর্ম বন্ধ করেনি ভারত। প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে বাংলাদেশিরা হত্যার শিকার হচ্ছে।
তিস্তাপাড়ের মানুষের এমনি ঘোর অন্ধকার দূর করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এগিয়ে এসেছে এ দেশের প্রকৃত বন্ধুদেশ চীন। দেশটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে অনেক দিন আগে। উপরন্তু চীন সরকার নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালানো শেষে উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভার ইয়েলো। সংস্থাটি উক্ত প্রকল্পের সার্বিক ড্রইং ডিজাইনও সম্পন্ন করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তারও সমুদয় অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার সম্মতি দিয়েছে চীনের একটি ব্যাংক। ইতোমধ্যেই ব্যাংকটি অর্থের যোগান দিতে আনুষ্ঠানিক চিঠিও দিয়েছে বলে জানা গেছে। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে: বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ডান-বাম উভয় তীর ঘেঁষে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ, রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তরাঁ, পর্যটন কেন্দ্র, ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, কয়েক লাখ হেক্টর কৃষি জমি উদ্ধার, বনায়ন ইত্যাদি রয়েছে। তাতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এতে পাল্টে যাবে তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষজনের জীবনমান। উল্লেখ্য যে, চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের অতিরিক্ত পানির আর প্রয়োজন পড়বে না বাংলাদেশের। কারণ, তিস্তা নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যায় উছলে ভাসাবে না গ্রাম-গঞ্জ জনপদ। সারাবছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অসংখ্য মানুষ রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করে মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন দ্রুত শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকায় অসংখ্য কল-কারখানা তৈরি হবে এবং ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন গত ১০ অক্টোবর বলেন, চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনা বিনিয়োগে বাংলাদেশের আপত্তি নেই।
যা’হোক, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের সর্বাধিক অবহেলিত ও দরিদ্র অঞ্চল-বৃহত্তর রংপুর তথা মঙ্গা কবলিত এলাকার মানুষের ভ্যাগোন্নয়নের পথ উন্মুক্ত হবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ন্যায়। উল্লেখ্য যে, পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যেমন যাত্রা শুরু হয়েছে, তেমনি হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বৃহত্তর রংপুর বাসীর। ফলে দরিদ্রতা, মঙ্গা, বেকারত্ব ও মরুকরণ স্থায়ীভাবে দূর হবে। আঞ্চলিক বৈষম্যও দূর হবে। তাই চীনা রাষ্ট্রদূতের উক্ত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের বিষয়টি এখন রংপুর বিভাগে সর্বাধিক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সর্বত্রই চলছে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। এমনকি ঢাকাস্থ রংপুরবাসীও ব্যাপক উল্লসিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য মহাকল্যাণকর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত এতদিন বাগড়া দিয়েছিল বলে খবরে প্রকাশ। দেশটির মানসিকতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য নিজেও কিছু করবে না আবার অন্য দেশ, বিশেষ করে চীনকেও কিছু করতে দেবে না। এটা চরম অন্যায়, অবন্ধুসুলভ ও আধিপত্যবাদী মনোভাবেরই প্রকাশ। তবুও এ দেশের ভারতপ্রেমীদের সে দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা সদা মশগুল বন্ধুবন্দনায়! অপরদিকে, ভারতের লোকজন ও মিডিয়া সদা মশগুল আওয়ামী বন্দনায়। এ দেশের স্বার্থ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। এ অবস্থায় এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তিস্তা চুক্তির আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। দেশের প্রখ্যাত পানিবিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতও সম্প্রতি বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের যা নেওয়ার দরকার তার সব কিছুই নিয়েছে। আমরা তা দিয়ে দিয়েছি অবলীলাক্রমে। ফলে ভারতের এখন আর কোনো গরজ নেই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে। এ অবস্থায় চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এমনি পরিস্থিতিতে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং হঠাৎ করে গত ৯-১০ অক্টোবর নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট এলাকার তিস্তা নদীর অববাহিকা ও দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শন করেন। সরজমিনে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখেন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন দ্রুত আলোর মুখ দেখবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যারেজ এলাকার সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে এবং দুই দেশের সরকারের প্রচেষ্টায় দ্রুত কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সবদিক দিয়ে পরিবর্তন ঘটবে এই এলাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনীতি, প্রকৃতি ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ মানুষের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি অবদান রাখবে। তিনি আরও জানান, তিস্তাকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি-সেচ ব্যবস্থা, মাছচাষ প্রকল্প, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
চীনা রাষ্ট্রদূতের উক্ত মন্তব্যে তিস্তাপাড়ের মানুষসহ সমগ্র দেশবাসীর মনে আশার আলো প্রজ্বলিত হয়েছে। মানুষের এ আশা-আকাক্সক্ষাকে পূরণ করতে হবে যথা শিগগির। সব আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত সম্পন্ন করে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। উপরন্তু নির্দিষ্ট সময় ও মানের মধ্যেই উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই স্বল্পদিনের মধ্যে মঙ্গা এলাকা বলে খ্যাত অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের আওতা ও মূল কর্ম হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে এক হাজার মিটারে সীমাবদ্ধ করা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবে। তাতে বলা হয়েছে, অবশেষে তিস্তা মহাপ্রকল্পের জট খুলতে শুরু করেছে। ভারতের চাপে দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখার পর চীনের অর্থায়নে তিস্তার নদীর জীবনরক্ষার মহাপ্রকল্পের ফাইল নড়তে শুরু করেছে। অনেক আগেই তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পের নদীর বাম তীরের সম্ভবতা যাচাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এখন প্রকল্পের প্রস্তাব পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। চীনের অর্থায়নে এই মেগা প্রকল্পের কাজ তিন ধাপে শুরু হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্য। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সে সময় দুই দেশের মধ্যে যে ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে তিস্তা প্রকল্পও ছিল।
অপরদিকে, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী নদীবন্দর নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছে একনেক গত ৮ জুন। ১৯৬৫ সাল থেকে এটি বন্ধ হয়ে রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। বন্দরটি চালু হলে চিলমারী এলাকায় বছরে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার যাত্রী ও দেড় লাখ টন মালপত্রের সুষ্ঠু ও নিরাপদ ওঠানামা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নৌবাণিজ্য ও অতিক্রমন প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রংপুর বিভাগ ব্যবসায়িক কেন্দ্র হয়ে উঠবে। অনেক কল-কারখানা স্থাপিত হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তাই এই প্রকল্পটিও যথাসময়ে ও মানসন্মতভাবে সম্পন্ন হওয়া দরকার।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা ও চিলমারী নদীবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এলাকাটির ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। পাশাপাশি উক্ত অঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে বহু মানুষের স্থায়ী কর্মসংস্থান হবে। সে সাথে শিক্ষা, চিকিৎসারও ব্যাপক উন্নতি হবে। তখন তাদের আর ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে রিকশা চালোনো কিংবা কুলি-মজুর ও কাজের বুয়া হওয়ার জন্য যেতে হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন