শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হতে হবে যৌক্তিক

| প্রকাশের সময় : ১৩ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে একাধিকবার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরও যখন জ্বালানি সঙ্কট ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে চলেছে তখন গতমাসে একবারে ৫০ শতাংশের বেশি জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয় সরকার। এরপর ৫ শতাংশ মূল্য কমানোর ঘোষণা দিলেও বাস্তবে বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এমনিতেই করোনাত্তোর অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আয় ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। আয়-রোজগার কমে গেলেও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে পণ্যমূল্য অব্যাহত গতিতে বেড়ে চলায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই আবারো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত রিপোর্টে আজ বৃহস্পতিবার পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য পুন:নির্ধারণে বিইআরসি’র সিদ্ধান্ত জানানোর কথা রয়েছে। আইন অনুসারে গ্যাস-বিদ্যুতের মত ইউটিলিটি সার্ভিসের মূল্য নির্ধারণে গণশুনানীর বিধান থাকায় ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে অংশীজনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়া সত্ত্বেও গত ১৮ মে বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে। ৯০ দিনের মধ্যে শুনানির রায় ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা থাকায় আজ ১৩ অক্টোবর এ ক্ষেত্রে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনমানের উপর বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার মানের অস্বাভাবিক অবনমন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভে টান পড়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ বিদ্যুতকেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় বিদ্যুতে লোডশেডিং বাড়িয়ে ঘাটতি পুরণের চেষ্টায় সারাদেশে গড়ে ৪ থেকে ৮ ঘন্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে কোথাও কোথাও ১০-১২ ঘন্টা বা তারো বেশি লোডশেডিংয়ের দুভোর্গের কথা জানা যায়। একদিকে মানুষ নিবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, অন্যদিকে উপর্যুপরি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলার এক দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এখন একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতেও বিদ্যুত সাশ্রয় এবং লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তে আসতে দেখা যাচ্ছে। বর্ধিত মূল্যে বিদেশ থেকে গ্যাস ও ডিজেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পাইকারি পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করা যায়না। জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানিতে বিপুল অংকের অর্থের প্রয়োজন, যা যোগান দেয়ার সামর্থ দেশের অর্থনীতির নেই। রির্জাভের অবস্থাও নাজুক। সে ক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। তবে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে কোনো সিদ্ধান্ত দেশের সাধারণ মানুষের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই নিতে হবে। সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় বাস্তবে কোনো সুফল বয়ে আনবে না।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে কোনো সিদ্ধান্ত বাজারে আরেক দফা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির কথাও শোনা যাচ্ছে। মানুষের আয় না বাড়লেও এভাবে ইউটিলিটি সার্ভিসের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের খাদ্য-পুষ্টি, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির কথা বলছে বিশেষজ্ঞরা।‘সবার উপর মানুষ সত্য’। রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে বিপন্ন করো তোলার মত পণ্যসেবা ও অর্থনীতি কাঙ্খিত নয়। আমাদেরকে বিদ্যুতের মত অপরির্হায সেবা নিশ্চিত রাখার কার্যকর উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, সেই সাথে সাধারণ মানুষের সঙ্গতি, মূল্যস্ফীতির ধকল ও কার্যকর নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। বিদ্যুতের মূল্য হতে হবে সামগ্রিক বিচারে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি, অপচয়, সিস্টেমলস, অবৈধ সংযোগ ও সব ধরণের অস্বচ্ছতা দূর করা সম্ভব হলে মূল্য না বাড়িয়েও লোকসান ও ভতুর্কি কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রায় প্রতিটি সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এসব অনাদায়ী বিল আদায় করে জ্বালানি খাতের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেই সাথে বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান এমনকি মসজিদ-মন্দিরসহ সব ধরণের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় বিদ্যুতবিল আদায়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী ও সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এসি, গাড়ী এবং আলোকসজ্জা পরিহার করে সকলকে জ্বালানি সচেতন হতে হবে। ফসিল জ্বালানি কমিয়ে আনার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবকাঠামো গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন