সমগ্র ফেনী জেলায় কিশোর গ্যাং কালচার এর দৌরাত্ম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালীন সময়ে এদের তৎপরতা তেমন একটা দেখা না গেলেও ইদানীংকালে ফেনীতে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাড়া, মহল্লায়, হাট বাজারে সহিংসতায় ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। গত মাসে কয়েকটি ঘটনায় ফেনীর মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রেম সংক্রান্ত বিরোধ, মাদকের ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধ, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, ছুরি-ছিনতাই,ইভটিজিং ও চাঁদাবাজি সহ খুনোখুনির মত ভয়ঙ্কর অপরাধ করছে “কিশোর গ্যাং”। রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং কথিত বড় ভাইদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে এসব কর্মকাণ্ডে। তাদেরকে ব্যবহার করা হয় বড় কিলিং মিশনেও। বিশেষ করে সমাজের নিম্নবিত্ত ও এলিট শ্রেণির পরিবারের সন্তানরা এসব ভয়ঙ্কর অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।
গত কয়েকদিনে ফেনীতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন আহত হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে লিয়াকত আলী নামের জিআরপি পুলিশের এক সদস্যকে কুপিয়ে জখম করে গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা ওই এলাকার মাদক ব্যবসা, চুরি-ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত। এ ঘটনায় পুলিশ জুয়েল,বাবু ও ইমন নামের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। ২৫ ফেনী শহরের একাডেমী রোডস্থ বালিকা বিদ্যানিকেতন স্কুলের সামনে এলএসকেবি, সেভেন স্টার ও এসিএক্স নামের তিনটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হলে তখন দুইজন এসএসসি পরীক্ষার্থী মারাত্মক আহত হয়। একইদিন রাতে পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে বখতিয়ার ভূঁঞা বাড়ির পাশে খালি মাঠে কিশোর গ্যাংয়ের একটি চক্রের মাদক সেবনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় মঈনুল হোসেন ডরিন নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে স্থানীয় আনোয়ার হোসেন, এমরানের নেতৃত্বে আইয়ুব আলী ও রাব্বীসহ সংঘবদ্ধ একটি গ্যাং।
এদিকে গত মাসের প্রথমদিকে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পায়। তখন সভায় জেলার দুই সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ সহ উক্ত কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ফেনী আসনের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন। এটি বন্ধ না হলে অপতৎপরতা বেড়ে যাবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং বন্ধ করতে হলে সহশিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। মোবাইল আসক্তির কারণে নতুন প্রজন্ম আজ ধ্বংসের পথে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এদিকে কিশোর গ্যাং দমনে জেলার ৬টি থানায় বীট অফিসারদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের ডাটা বেইজ তৈরি, এলাকাভিত্তিক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সহ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নানা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
সুশিল সমাজ মনে করছেন, পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনতার কারণে তারা কিশোর গ্যাংয়ের মতো এসব নোংরা কালচারে জড়িত পড়ছেন। তারা মনে করেন, একদিকে পারিবারির শিক্ষার অভাব, সামাজিক অসচেতনতা অন্যদিকে ইসলামী শিক্ষার অভাব ও অপসংস্কৃতির কারনে কিশোর-তরুণরা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে জীবন বিপন্ন করছেন।
সুজন সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, কিশোরদেরকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়াও মাদক, সন্ত্রাস, হত্যা সহ বিভিন্ন অপরাধে অপব্যবহার করছেন।
ফেনী সরকারি কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক এম ডি ফখরুল আমিন ইনকিলাবকে বলেন, কিশোররা সঠিকভাবে বেড়ে উঠার পেছনে গুরু দায়িত্ব রয়েছে অভিভাবকদের। কিন্তু তাদের সন্তানরা কি করে, কোথায় যায়, কার সাথে আড্ডা দেয় ঠিকমত খেয়াল রাখার সময় এখন পরিবার গুলোর নেই। আজ তারা কিশোর থেকে বড় সন্ত্রাসী হয়ে বেড়ে উঠছে।
ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, এ ব্যাপারের আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা কিশোরদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করছি, পাশাপাশি অভিভাবকদেরকে সচেতন করছি। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে ইনশাআল্লাহ একসময় এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন