বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য অপরাজনীতি দায়ী

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন নিয়ে যে প্রশ্ন ও অভিযোগ রয়েছে, তার জন্য মূলত সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিতক দলগুলোর প্রথাগত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দায়ী। সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পরস্পরবিরোধী এই অপরাজনীতিই মূলত সুস্থ, শালীন ও যৌক্তিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। ক্ষমতাসীনদল যেমন বিরোধীদল ও তার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আক্রোশ থেকে অশালীন, অসত্য, অযৌক্তিক, প্রতিহিংসামূলক ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়, তেমনি এর প্রতি উত্তরে বিরোধীদলগুলোও একইভাবে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়। পরস্পরবিরোধী এ ধরনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ সুষ্ঠু মত প্রকাশ কি, সে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। এসব বক্তব্য-বিবৃতি কিংবা তথাকথিত মেঠো বক্তৃতাই সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, যৌক্তিক ও শালীন মতপ্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার তার বিরুদ্ধে যাতে কেউ কিছু বলতে না পারে, এজন্য কণ্ঠরোধ করার জন্য নানা কালাকানুন প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদল নিজেকে না শুধরে আইনগুলো করছে। অর্থাৎ নিজে বিরোধীদল ও মতের বিরুদ্ধে যা খুশি তা বলতে পারবে, তার বিরুদ্ধে কেউ বলতে পারবে না। এক্ষেত্রে যদি ক্ষমতাসীনদল দায়িত্বশীল হয়ে আপনি আচরি ধর্ম অপরকে শেখাও নীতি অবলম্বন করত, শুধু বিরোধীদল ও মতকে দমনের জন্য যা খুশি না বলার সুস্থ আচরণ করত, তাহলে মতপ্রকাশের নামে অশালীন, অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক কথাবার্তা অনেকটাই কমে যেত এবং সত্যিকারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হতো। এর প্রভাব দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ওপরও পড়ত। এ কাজটি না করে ক্ষমতাসীনদল আইন করে মানুষের মুখ বা কথা বলা বন্ধ করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। এটি আত্মঘাতী এবং গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায়। ক্ষমতাসীন দল এটা ভাবে না, তাকেও এক সময় বিরোধীদলে যেতে হবে, তখন এই আইনের খড়গে তাকেও পড়তে হবে। তখন তার আফসোস করার কিছু থাকবে না। অন্যদিকে, বিরোধীদল ক্ষমতায় গিয়ে যদি এসব আইন বাতিল করে এবং সুষ্ঠু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং গণতন্ত্র ও মানুষের সুষ্ঠু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথ মসৃণ হবে। তা নাহলে, ক্ষমতা থেকে চলে গেলে তাকেও একইভাবে বিগত সরকারের মতো নিন্দিত হতে হবে। মূল কথা হচ্ছে, সুষ্ঠু ও যৌক্তিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ক্ষমতাসীনদল ও বিরোধীদল উভয়কেই ভদ্র আচরণ ও যুক্তির মাধ্যমে কথা বলার সংস্কৃতি চালু করতে হবে।

দুই.
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ দেশে এবং বিদেশে রয়েছে। বহু বছর ধরেই এই অভিযোগ চলে আসছে। ক্ষমতাসীনদলের শীর্ষ পর্যায় তো বটেই, মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে এবং তা যদি যৌক্তিকও হয়, সে ব্যাপারে কথা বলা বা সমালোচনার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। কেউ সমালোচনা করলেই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন অসংখ্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ফরিদপুরে বিরোধীদল বিএনপি’র এক কর্মী তার দলের চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষপর্যায় থেকে কিছু মন্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের কারণ মানহানি। এমন ঘটনা বিগত কয়েক বছর ধরেই ঘটছে। বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদলের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যায়, এমন সমালোচনা করলে এবং তা পছন্দ না হলে সমালোচনাকারীর গ্রেফতার ও কারগার অনিবার্য হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার পর থেকেই এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। আইনটির শুরু থেকেই রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সচেতন মহল এর কয়েকটি ধারা নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। ধারাগুলো বাদ দেয়ার দাবী জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ ধারাগুলো স্বাধীনমত ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। তাদের অভিযোগ, সরকার তার বিরোধীমত ও বাকস্বাধীনতাকে দমন করার জন্য এ আইন করেছে। দেখা যাচ্ছে, তাদের এ কথা বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আইনটি প্রণয়নের পর সাংবাদিক, পেশাজীবী, লেখক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ওপরও ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল বা তার নেতা-কর্মীদের নিয়ে সমালোচনা করলেই অপপ্রচার ও মর্যাদাহানির অভিযোগ এনে মামলা এবং গ্রেফতার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখা হচ্ছে। জামিন চেয়েও পাওয়া যায় না। ২০২০ সালে লেখক মুশতাক আহমেদকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া হয়। বেশ কয়েকবার জামিন চেয়েও পাননি। অবশেষে ২০২১ সালে জেলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনা দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে যায় এবং তা যতই যৌক্তিক ও বাস্তব হোক না কেন, সমালোচনাকারী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও সরকার তা সহ্য করে না। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাসীন দল তার বিরোধীমতের বিরুদ্ধে যেমন খুশি তেমন বলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। অন্যদিকে, তার সমালোচনা বা মতের বিরোধিতা করলে এবং তা মনঃপুত না হলে আর রক্ষা নেই। এতে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে একধরনের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সংবাদ ও গণমাধ্যম স্বেচ্ছায় সেল্ফ সেন্সরশিপে চলে গেছে। উচিৎ কথা বলা থেকে বিরত থাকছে। তারপরও কোনো ব্যক্তি যখনই সাহস করে কিছু বলেছে বা লিখেছে, অনিবার্যভাবেই বিপদে পড়তে হয়েছে। মামলা ও গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিক্যাল নাইনটিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে। এছাড়া পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারাও ব্যবহার করা হয়েছে। সংস্থাটির ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিজিটাল আইনের অধীনে প্রায় ১৯৮টি মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৪৭৫ জনকে। এর মধ্যে ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। গত বছর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৭৬টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলার সংখ্যাই বেশি। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকের স¤পাদকের বিরুদ্ধে ৭০টিরও বেশি মামলা হয়েছিল মানহানির অভিযোগে এবং ৫৭ ধারায়। তিনি বলেছেন, ‘ভয়ের পরিবেশের কারণে’ স্বাধীন সাংবাদিকতার অবনতি হয়েছে। এটা সরকার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারপক্ষীয় লোকজনের অসহিষ্ণুতার কারণে হয়েছে। সবকিছু মিলে একটা ‘দমনমূলক’ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার অবনতি হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মামলায় অভিযুক্তদের সকলের মত যে যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য তা মনে করার কারণ নেই। আবার সকলের ব্যক্তিগত অবস্থান ও গুরুত্বও যে সমান তাও নয়। তবে যেসব সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন, তাদের একটা অবস্থান রয়েছে। তারা নিজস্ব বোধ-বুদ্ধি ও সচেতন চিন্তা থেকেই মতপ্রকাশ করেছেন। তাদের এই মতামত সরকারের পছন্দ হয়নি বলেই জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। এজন্য দেশের আইনজ্ঞ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সচেতন মহল এবং জাতিসংঘ ও বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা বাতিল ও সংশোধ করার জন্য বারবার বলেছে।

দুই.
বাকস্বাধীনতার বিষয়টি সাধারণত নির্ভর করে রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃবৃন্দ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সচেতন নাগরিক মহলের উপর। তাদের দায়িত্ব জনসাধারণের জন্য উচিত-অনুচিত এবং কল্যাণ-অকল্যাণমূলক ঘটনা এবং কথাবার্তা সুবিবেচনাপ্রসূত অথচ অবারিতভাবে প্রকাশ করা। এ দায়িত্ব পালনে তারা কতটা স্বাধীন বা তাদের করতে দেয়া হচ্ছে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ ফ্রিডম অফ স্পীচ বা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত ‘ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’-এর আর্টিক্যাল ১৯-এ বলা হয়েছে, কোন ধরনের বাধা ছাড়া প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশ ও ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে সব ধরনের তথ্য খোঁজা, গ্রহণ করা এবং তা বলা, লেখা, শিল্পকলাসহ যত ধরনের প্রকাশ মাধ্যম রয়েছে, তার পছন্দমতো মাধ্যমে প্রকাশ করা। তবে এ স্বাধীনতা সতর্কতার সাথে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে চর্চা করতে হবে, যাতে অন্যের অধিকার ও সম্মানহানি এবং জাতীয় ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক জন মিল্টনের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘গিভ মি দ্য লিবার্টি টু নো, টু আটার, অ্যান্ড টু আরগু ফ্রিলি অ্যাকোর্ডিং টু কনসায়েন্স, অ্যাভাব অল লিবার্টিস।’ তিনি বাকস্বাধীনতার নামে যা খুশি তা বলার অধিকার চাননি। যা সত্য এবং উচিৎ, তাই বলতে দেয়ার দাবী করেছেন। এক্ষেত্রে কে সরকারের সমালোচনা করছে, তার অবস্থান কি এবং তার কথার গুরুত্ব কতটা তা বিবেচনা করতে হয়। এসব বিবেচনায় যদি তার মতামত যৌক্তিক হয় এবং সরকারের বিপক্ষে যায়, তা গ্রহণ করা বা তার পাল্টা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশকে নিশ্চিত করা। প্রখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমার মতের সাথে আমি একমত না হলেও, তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি।’ তার এ কথা সার্বজনীন হলেও, সবাই যে মতামত প্রকাশ করে, তা নয়। প্রকাশ করে সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে জড়িতদের কেউ কেউ, যাদের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে এবং গ্রহণযোগ্য। তারা নিশ্চয়ই সরকারের ভুল-ত্রুটি বা অন্যায্য আচরণের বিরোধিতা বিদ্বেষ থেকে করেন না। সরকার ও দেশের মঙ্গলের জন্যই করেন। এতে সরকার ক্ষুদ্ধ না হয়ে বরং তা গ্রহণ করে সংশোধন করতে পারে। মতামত খণ্ডনে পাল্টা যুক্তি দিতে পারে। দেখা যাচ্ছে, সরকারের বিপক্ষে যায়, এমন মত সহ্য করার প্রবণতা খুবই কম। তার আচরণ এমন, যে কথা তার জন্য সুবিধাজনক সেটাই সঠিক, বিরুদ্ধে গেলেই বেঠিক। অথচ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার নিউক্লিয়াসই হচ্ছে, অন্যের মতামত পছন্দ না হলেও তার গুরুত্ব দেয়া। বিশ শতকে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘তুমি যদি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তবে তোমাকে ধরেই নিতে হবে, তোমার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির বাকস্বাধীনতাকে পছন্দ করতে হবে।’ ইতিহাস থেকে জানা যায়, একনায়করাও তাদের বিরুদ্ধবাদীদের মতামত পছন্দ করতেন। আমাদের দেশের মতো গণতন্ত্রকামী দেশে যেখানে গণতন্ত্র পুরোপুরি ভিত্তি লাভ করেনি, সেখানে গণতন্ত্র অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উঠানামার মতো অবস্থায় রয়েছে। গণতন্ত্রকে একেক দল বা গোষ্ঠী তাদের সুবিধা মতো সংজ্ঞায়িত করেছে এবং করে চলেছে। মুখে মুখে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের উদাহরণও প্রায়ই দেয়া হয়। গণতন্ত্রের এসব উদাহরণ দেখিয়ে জনসাধারণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি করলেও কার্যক্ষেত্রে এর চর্চা এবং প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে। এখন তো গণতন্ত্রের মোড়কে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অথচ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পরিতাপের বিষয়, যাদের নেতৃত্বে জনগণ সংগ্রাম করেছে, ক্ষমতায় আসার পর তাদের দ্বারাই গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে। জনসাধারণের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা যায়, ব্রিটিশ, আমেরিকার গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করতে শত বছর লেগেছে। তাদের দেড়-দুইশ’ বছরের গণতন্ত্র। আর আমাদের যাত্রা তো সবে শুরু। তাদের এসব কথার মধ্যে যে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ও শাসন-শোষণের সমর্থনসূচক মনোভাব রয়েছে, তা সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের এ কথার অন্তর্গত অর্থ হচ্ছে, শতবর্ষ না পেরুলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, কাজেই জনসাধারণকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তারাই যখন ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করে, তখন দেশের মানুষের আশ্চর্য হওয়া ও আফসোস করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। দেশের রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যদি এ ধরনের মনোভাব থাকে, তবে শত বছর কেন, হাজার বছরেও গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করবে না। মানুষের বাকস্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে না। যারা উচিত কথা বলতে যাবেন, তাদেরকে পদে পদে হুমকি-ধমকির মধ্যেই থাকতে হবে।

চার.
ফ্রিডম অফ স্পীচ গণতন্ত্রের ‘সেফটি ভাল্ভ’ বা নিরাপদ কপাট হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব ব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড গর্ভনেন্স ইন্ডিকেটরস’ প্রজেক্টের আওতায় কিছুকাল আগে বিশ্বের ২০০ দেশের উপর করা জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশে বাকস্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া রয়েছে, সেসব দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র সংহত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা একদমই কম বলে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজ সংস্থার ২০২১ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ‘আংশিক স্বাধীন’› দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের স্কোর ১০০ মধ্যে ৩৯। এর মধ্যে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অধিকারে ৪০-এ ১৫ এবং নাগরিক স্বাধীনতায় ৬০ এর মধ্যে ২৪ পেয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব দেশ ও অঞ্চলের স্কোর গড়ে ১ থেকে ৩৪ এর মধ্যে, তাদের ‘স্বাধীন নয়’, ৩৫ থেকে ৭১ হলে তাদের ‘আংশিক স্বাধীন’ এবং ৭২ এর বেশি হলে তাদেরকে ‘স্বাধীন’ বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে মত ও বাকস্বাধীনতার পরিস্থিতি কি। বরাবরের মতো সরকার এসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এই প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা কখনো মঙ্গল বয়ে আনে না। বরং সরকারের উচিৎ,এ ধরনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধরে নেয়া। এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে গণতান্ত্রিক ধারা ও বাকস্বাধীনতার সংকোচন নীতি পরিহার করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাসহ সকল কালা-কানুন যা গ্রহণযোগ্য নয়, তা সংশোধন ও বাতিল করবে। সরকার ও বিরোধীদলগুলো এমন রাজনৈতিক সুসংস্কৃতি সৃষ্টি করবে যেখানে শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি থাকবে না। থাকবে সুষ্ঠু, শালীন, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মতামত প্রকাশের সংস্কৃতি। তাহলেই কেবল সত্যিকারের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন