এ মাসের শেষদিকে বঙ্গোপসাগরে একটি প্রবল শক্তির নিম্নচাপ ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘গ্লোবাল ফোরকাস্টিং সিস্টেম (জিএফএস) এর আগাম সতর্কবার্তায় অক্টোবরের ১৮ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি সুপার সাইক্লোন সৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। থাইল্যান্ডের আবহাওয়া বিভাগ এই সাইক্লোনের নাম দিয়েছে ‘সিত্রাং’ বা পাতা। আশঙ্কিত সাইক্লোনটির গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০- থেকে ২৫০ কিলোমিটার বা তারো বেশি হতে পারে, যা সুপারসাইক্লোনের গতি হিসেবে বিবেচ্য। এটি বিগত ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলা ও পরবর্তী সময়ের আম্ফানের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে এর সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল থেকে উত্তর দিকে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলসহ দুই দেশের উপকূলীয় অন্তত ১৯টি জেলায় বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। সাগরে বাতাসের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে লঘুচাপ ও শক্তিশালী ঝড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। বর্তমানে সাগরে ২৮ ডিগ্রি সে. এর বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে বলে জানা যায়। সেই সাথে একই সময়ে অমাবশ্যার জোয়ার থাকায় সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ও ধ্বংসক্ষমতা অনেক বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৈশ্বিক সংকট এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এমনিতেই বাংলাদেশ একটি নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন। এহেন বাস্তবতায় একটি সুপার সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিতে পারে। একেকটি সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় দেশের কৃষি, মৎস্য ও বনজ সম্পদের উপর বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে দিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের বেশকিছু এলাকা এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ফসলি জমিতে সামুদ্রিক নোনাপানি ঢুকে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা আমাদের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। বিশেষত উপকূলীয় চরাঞ্চল ও সুন্দরবন এলাকায় বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। অক্টোবরের ১৮ বা ২০ তারিখ থেকে সিত্রাংয়ের প্রভাব শুরু হওয়ার কথা, তাই হাতে সময় খুব বেশি নেই। লাখ লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ আশ্রয় এবং ত্রাণতৎপরতার বিষয়টি নিয়ে এখনি ভাবতে হবে। তবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের উৎপত্তি ও গতিপ্রকৃতি এখনো সুস্পষ্ট নয়। জিএফএস-সহ যেসব আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থা এ নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে, তাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখে প্রতি মুহূর্তের আপডেট তথ্য বিনিময় নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে বাংলাদেশের আবহাওয়া দফতরকে নিজস্ব জনবল এবং প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব সংস্থাগুলো আগামী বছরে একটি অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষাবস্থার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশে একটি মন্দা ও দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক থেকে প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলছেন। এর মধ্যে এই সুপার সাইক্লোনের খবর নতুন শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য। সাগরে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা লঘুচাপ ও উপকূলীয় সাইক্লোন সৃষ্টির জন্য দায়ী। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তথা উষ্ণতাবৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার ফল তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে ক্লাইমেট চেঞ্জ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধাসমূহ আদায় করে নেয়ার কার্যকর উদ্যোগের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবেলা ও ত্রাণ তৎপরতায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ জনসাধারণের প্রসংশনীয় সাফল্য ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই মুহূর্তে দূরবর্তী সতর্কতা ছাড়া, এখনো আতঙ্কিত হওয়ার মতো তেমন কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে গত কয়েকদিনে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঢাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাতের তথ্য দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কথিত সুপার সাইক্লোনের জন্য সাবধানতা ও প্রস্তুতি নিশ্চিত রাখাই এখন সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব। তবে এবার বৈশ্বিক চলমান অর্থনৈতিক মন্দাকে সামনে রেখে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্ভাব্য প্রস্তুতির পুরোটা নিজেদেরকেই নিতে হবে। উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তা, পুনর্বাসন ও আশঙ্কিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সমন্বয় এবং কারিগরি ব্যবস্থা জোরদার করে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু সিত্রাংয়ের আকৃতি ও গতিপ্রকৃতি এখনো প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে আবহাওয়া দপ্তরকে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের দিকে সার্বক্ষণিক সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থার সাথে নিবিড় যোগাযোগ ও স্যাটেলাইট ইমেজগুলোর উপর নজর রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন