শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০১ এএম

যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর মানুষ একই নিয়মে চলেনি। পরিবর্তন হয়েছে। সমাজে যখন ঘুণে ধরে তখন প্রাকৃতিক নিয়মে একজন সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সমাজ কোন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে? পত্রিকার পাতা খুললে ঘটনার চেয়ে দুর্ঘটনা, ঈমানদারীর চেয়ে বেঈমানী, শালীনতার চেয়ে অশ্লীলতার সংবাদ চোখে পড়ে বেশি। বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থায় যে যত নগ্ন হতে পারে, সে তত বড় সংস্কৃতিসেবী। যে যত ধর্মবিরোধী কথা বলতে পারে, সে তত প্রগতিশীল। কিছু ব্যক্তির ধর্মের সমালোচনা শুনে মনে হয়, তারা ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’। ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা এক নয়। মোটাদাগে ধার্মিক সেই ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে, তার প্রতিটি কর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

পৃথিবী এক সময় ছিল অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবসমাজে স্বীকৃতভাবে নারী-পুরুষ ছিল বহুগামী। একাধিক পুরুষের সংস্পর্শে আসা নারীর সন্তানের পিতৃ পরিচয় হতো সন্তানের চেহারার সাথে মিলিয়ে। ১৫০০ বছর আগে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ওই অশ্লীল প্রথার বিলোপ সাধন করেন। মুসলিম আইনে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে বেশি ঢাকঢোল পিটানোর প্রয়োজন হয় না। নবী করিম (সা.) নির্দেশিত পন্থায় বিয়ের জন্য তিনটি বিষয় অবশ্য পালনীয় যথা: ১. বিয়ের জন্য প্রস্তাব ও প্রস্তাব গ্রহণ ২. সাক্ষী ৩. দেনমোহর।

ইসলামে পর্দাপ্রথা সম্পর্কে কঠিন নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পর্দাপ্রথাকে এখন কোথাও কোথাও ব্যাকডেটেড বলা হয়। বলা হয়, পর্দাপ্রথা আধুনিকতার পরিপন্থী। পুরুষ ও নারীদের পর্দাবহির্ভূত মেলামেশা এখন সমাজকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। পত্রপত্রিকা খুললে জানা যায়, খুন এবং বেশির ভাগ খুনের পেছনে রয়েছে পরকীয়া। পরকীয়ার এক ধাপ উপরে উঠে শুরু হয়েছে লিভ-টুগেদার। বিভিন্ন হোটেলে নারীদের লাশ পাওয়ার পেছনে রয়েছে পরকীয়া আর লিভ-টুগেদার। নারী নির্যাতনের আইন রয়েছে। পরকীয়ায় যখন আর্থিক লেনদেন বা কোনো বিষয়ে টানাপড়েন চলে তখন দেখা যায় কিছু মহিলা নারী-নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেয়। ফলে সময় এসেছে, আমাদের দেশে পরকীয়া ও লিভ-টুগেদারকে বেআইনি ঘোষণা করে আইন পাস করার। সাম্প্রতিকালে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেকের বিয়ে ছাড়া সন্তান জন্ম হওয়া সম্পর্কে ফেসবুকে কিছু বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এতে আপত্তি কোথায়? তাদের মনমগজে ধর্মের ব্যাপারে অনীহা ঢুকে পড়ায় তারা এ ধরনের মনগড়া মতবাদ চালু করে নিজেদের প্রগতিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়।

আমাদের সমাজ বাস্তবতায় পরকীয়া ও লিভ-টুগেদার একটি বিষফোঁড়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন ছাড়াও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। লিভ-টুগেদার সমাজ ও পরিবারে মারাত্মক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। সন্তানের পিতৃপরিচয়ে সৃষ্টি হচ্ছে আইনগত জটিলতা। ভদ্রবেশী উপরতলার মানুষের মধ্যে লিভ-টুগেদারের প্রবণতা বেশি। ধনীক শ্রেণির মধ্যে টাকার জোরে লিভ-টুগেদার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিছুদিন আগেও রাখঢাক করে অতিসঙ্গোপনে লিভ-টুগেদার করা হতো, হালে তা করতে সংশ্লিষ্টরা গর্ববোধ করে।

‘আত্মহত্যা’ একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মান অভিমান ছাড়াও অভাব-অনটন এবং মানসিক বিকারগ্রস্ততায় দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। সন্তানদের হত্যা করে মা বা পিতার আত্মহত্যা এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। পরকীয়ার কারণে স্বামী খুন হচ্ছে স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে, অন্যদিকে স্ত্রী খুন হচ্ছে স্বামীর হাতে। অথবা দু’জনই একসাথে আত্মহত্যা করছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন ঘটনাও ঘটছে অনেক।

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নিজেকে সম্মান করার প্রবণতা অনেক মানুষের নেই। এ দুটোর অভাবে একজন ব্যক্তির জীবন আবদ্ধ হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলার ডাণ্ডাবেড়িতে, দিনে দিনে যা গভীর থেকে গভীরত হয়, সে গভীরতা থেকে ফিরে আসা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। দৃঢ় মনোবল ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এসব বিপর্যয় থেকে উঠে আসা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কাউন্সেলিং সিস্টেম চালু হয়নি। সমাজসেবক বা সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে কাউন্সেলিং প্রথা চালু হলে বখাটে কিশোর গ্যাং ও বিপর্যস্ত মানুষকে সঠিক পথে আনয়ন করা সম্ভব হতে পারে।

পরিবার হচ্ছে শিশু-কিশোরদের শিক্ষাগ্রহণের প্রথম বিদ্যালয়। প্রত্যেক শিশু পর্যায়ক্রমে বড় হওয়ার সাথে সাথে তাকে শিক্ষা দিতে হয় কীভাবে নিজেকে নিজে সম্মান করতে হয়। তখন তার মধ্যে জাগ্রত হয় অন্যকে সম্মান দেয়ার প্রবণতা। এটাও শিক্ষা দিতে হবে নিজেকে নিজে ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখার পদ্ধতি সম্পর্কে। অন্যদিকে বলা যায়, পিতা-মাতা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। পিতা-মাতা বা পরিবারটি যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াস অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই শিশু-কিশোরদের নার্সিংয়ের বিষয়টি হালকাভাবে দেখা যাবে না।

কিশোর গ্যাং সমাজে আরেকটি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ২০-১১-১৯৮৯ কনভেনশন অন দ্য রাইট অব দ্য চাইল্ড সম্মেলনে শিশুর বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়। সে আলোকে শিশু আইন-২০১৩ আইনে শিশুর বয়স বাংলাদেশে ১৮ বছর নির্ধারিত হয়েছে। শিশুআইন-১৯৭৪ এ শিশুর বয়স নির্ধারিত ছিল ১৬ বছর। বাংলাদেশ পেনাল কোডের-৮২ ধারা মোতাবেক ৭ বছরের নিচে কোনো শিশুর আইনবহির্ভূত ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। ওই আইনে ৮৩ ধারা মোতাবেক, বিচারকের দৃষ্টিতে ১২ বছরের কোনো শিশুর যদি ম্যাচুরিটি শনাক্ত না হয় সে ক্ষেত্রেও শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না। ডিজিটাল যুগে ১৬-১৮ বছরের একজন কিশোর যথেষ্ট ম্যাচুরিটি লাভ করে। বর্তমানে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে আইনের সুবিধা ভোগ করছে। কথিত এসব শিশু-কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে এবং দেশি-বিদেশি সিনেমা অনুসরণে হিরো সাজার জন্য পাড়া মহল্লায় তারা একের পর এক অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। তাদের হাতে রয়েছে দেশি বিদেশী অস্ত্র। অনেকে পাড়া মহল্লায় মাদক ব্যবসায়ও নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।

একজন শিশুর প্রথম পাঠশালা পরিবার। বাবা-মা প্রথম শিক্ষক। যখন কোনো পরিবারে বিশৃঙ্খলা ও উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দেয়, তখন থেকে তারা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে। কিছু কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয় অসচ্ছল পরিবার থেকে অভাব অনটনের কারণে। পরিশেষে একথা বলা যায়, উল্লেখিত সামাজিক ব্যাধিগুলো আমাদের পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রকে দিন দিন গ্রাস করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন