ঠিকমত করতে পারলে সব্জি চাষে প্রচুর লাভ। সব চাষের মতো এক্ষেত্রেও প্রধান কথা জমি বা মাটি। জমিতে সারাদিন রোদ লাগা চাই, পানি যেন না জমে, পানি সেচের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। দোআঁশ মাটি সব্জি চাষের পক্ষে সবচেয়ে ভালো। মাটির ধরন এঁটেল বা বালুর দিকে হলে ঠিকমত চাষ ও শ্রম ব্যয় করে তাতেও ভালো সব্জি ফলানো যায়। তবে জমি যেন ক্ষার বা বেশি লোনা না হয়, বেশি টক ভাবও ভালো নয়। এজন্য মাটি পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। টকভাব কাটাতে চুণ দিতে হবে মাটিতে।
নিয়মিত সার প্রয়োগে সব্জির গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে। নাইট্রোজেন, ফসফেট এবং পটাশ সারের কথা সবার জানা। আগেরকার দিনে এসব সার ছিল না। তখন ব্যবহার হতো গোবর সার, পচা পাঁক, খৈল ইত্যাদি। এগুলো সবই জৈব সার।
আজকাল রাসায়নিক সার পাওয়া যাচ্ছে। তাই ব্যবহারও হচ্ছে বেশি। জৈবসার যে ফসলের পক্ষে অপরিহার্য, এ কথাটা লোকে ভুলতে বসেছে। তাই দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। ফুলকপির ডাঁটা ফাঁপা হয়ে যাওয়া, ফুলের রং গোলাপী হওয়া বা পাতা ইঁদুরের লেজের মতো সরু হয়ে যাওয়া তো এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। জমিতে দস্তা জাতীয় সার না দিলে অনেক জায়গায় আজকাল ধানও ভালো হচ্ছে না। রজনীগন্ধার ফুল কুঁড়ি অবস্থায় থেকে যাচ্ছে, ফুটছে না। আরও নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে- যার হদিশ চাষিরা তো দূরের কথা, বিশেষজ্ঞরাও খুঁজে পেতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে প্রধানত জৈবসার ব্যবহার না করার ফলে। ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে থাকলে সমস্যাগুলো বেড়ে গিয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছবে, যখন সমাধান হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই শুরু থেকেই সাবধান হতে হবে।
সব্জি চাষের জন্য প্রতি হেক্টরে কমপক্ষে ১৫ টন গোবরসার বা কম্পোস্ট, সেই সঙ্গে অন্তত তিন কুইন্টাল সিঙ্গেল সুপার ফসফেট দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এ সারগুলো জমি তৈরির শুরুতে লাঙ্গল দেয়ার সময় দিতে হবে। চাপান সারের জন্য যতটা নাইট্রোজেন দেওয়ার সুপারিশ আছে তার অর্ধেকটা আসা উচিৎ খৈল থেকে। নিম বা সর্ষের খৈলই সব্জির পক্ষে ভালো। বেগুন, ঢেঁড়স বা টমেটোর মতো লম্বা সময়ের ফসলে সুপার ফসফেটের বদলে হাড়ের গুঁড়ো দেওয়া ভালো। যথেষ্ট জৈবসার না থাকলে সবুজ সারের চাষ করতে হবে।
জমিরও বিশ্রাম দরকার। বিকেল বেলা মটরের ফসল তুলে ক্ষেত খালি করার পর রাতভর বিজলি বাতির আলোয় কলের লাঙ্গল আর পাম্প চালিয়ে জমি তৈরী করে সকালবেলা ধানচারা রোয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এটা ঠিক নয়। জৈব সার দেওয়ার পর অন্তত তিন সপ্তাহ বাদে পরের ফসল লাগানো উচিত।
ফলন বেশি হলেই যে সব্জি চাষে লাভ বেশি হবে, এ ধারণা ঠিক নয়। যে টমেটো অসময়ে পনেরো টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, মওশুমে সে টমেটোর ফলন দু-তিনগুণ বেড়ে যায়, কিন্তু তখন দাম এত কমে যায় যে লাভ তো দূরের কথা, মাঠ তোলার মজুরিও ওঠে না। আসল কথা, অন্যরা যে সব্জি করতে পারবে না, সে সব্জিতেই বেশি লাভ। বেমওশুমে ফলন পাওয়ার জন্য আজকাল টমেটো, বাঁধাকপি প্রভৃতি হাইব্রিড জাত পাওয়া যাচ্ছে। এসব বীজের দাম সাধারণ বীজের চেয়ে বিশগুণ বেশি। তবুও বীজের চাহিদা মিটছে না। কারণ, ফসল বিক্রী করে যে পয়সা পাওয়া যাচ্ছে, তার তুলনায় এ উচ্চমূল্যের বীজের দামও নগণ্য। পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঘন বর্ষায়ও তৈরী হচ্ছে ধনে পাতা, পালং, তৈরি হচ্ছে জলদি জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি। হাইব্রিড জাতের টমেটো গাছকে বেমওশুমে ভাইরাস রোগ থেকে বাঁচাতে এগুলোকে জমিতে লাগানো হচ্ছে নাইলনের মশারি টাঙ্গিয়ে। যত্ন-খাতির সবকিছু খরচ ফসলের উঁচু দামের জন্য সহজেই পুষিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সব্জি চাষে চাষীরা চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে আসতে চাইছে। ভালো ফসল পেতে হলে যে ভাল জাত চাই- একথা সবার জানা। হাইব্রিড জাতগুলো শুধু যে অসময়ে ফসল দেয় তা নয়, ফলনও হয় বেশি, গুণের দিক দিয়েও উচ্চস্তরের। গত মওশুমে শীতের সময় পুসা রুবি বা পাথরকুচি জাতের টমেটোর দাম যখন প্রতি কেজি এক টাকা, সে সময় হাইব্রিড জাতের টমেটো বিক্রি হয়েছে দু-আড়াই টাকায়, তাদের উচ্চমানের জন্য।
সুস্থ, সতেজ চারা ছাড়া ভাল ফলন পাওয়া যায় না। এজন্য প্রথমে চাই সুপুষ্ট বীজ। বোনার আগে লবন পানিতে ডুবিয়ে ভাল বীজগুলো আলাদা করে নিতে হবে, পারদ জাতীয় ঔষধ দিয়ে বীজ শোধন করে বুনে দিতে হবে। চারা গজানোর পর বেছে বেছে তেজি কচি চারা তুলে অন্য নার্সারিতে কমপক্ষে আড়াই-তিন সেমি দূরত্বে লাগিয়ে দিতে হবে। এভাবে তৈরী চারা বেশ সুস্থ ও সবল হবে, একই যত্নে ফলন দেবে অনেক বেশী, রোগের আক্রমণও ঠেকাতে অপেক্ষাকৃত বেশি সক্ষম হবে।
বীজ বোনা হোক বা চারা বসানো যাক, সবসময় ফসল লাগাতে হবে সারিতে। এতে নিড়ানি দেওয়া, চাপান দেওয়া, তোলা প্রভৃতি কাজ সহজে এবং কম খরচে হবে। গাছগুলো বড় হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা পাবে এবং জমিতে বেশি গাছ রাখা যাবে।
ফসলকে রোগ-পোকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কেবল ঔষধের উপর নির্ভর করা ঠিক নয়। রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ যাতে আদৌ না হয়, সে চেষ্টা করাই বেশি ভাল। এজন্য যা করতে হবে তা হলো:
১. বীজ শোধন করতে হবে। ২. উপযুক্তভাবে বীজতলা তৈরি করে ঔষধ দিয়ে চারাকে রোগমুক্ত রাখতে হবে। ৩. আগাছা নির্মূল করতে হবে। ৪. নিয়মিত খাবার দিতে হবে। ৫. উন্নতমানের জাত ব্যবহার করতে হবে।
ঔষধ দেওয়ার সময় তা উপযুক্ত মাত্রায় দিতে হবে। এমন যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে যেন ঔষধ ধুলো বা কুয়াশার মতো গাছের সারা শরীর ঢেকে ফেলে। রোগ বা পোকা ঠিকমত চিনে নিয়ে সঠিক ঔষধ বেছে ব্যবহার করতে হবে। অযথা ঘন ঘন বা বেশী মাত্রায় ঔষধ ব্যবহার করা বিপদজনক। নির্দেশের চেয়ে কম মাত্রায় ঔষধ ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
ফসল তাজা ও চকচকে অবস্থায় ফসল তুলতে হবে। টমেটো, আলু, কচু, ওল প্রভৃতি দু-চারটে ফসল ছাড়া অধিকাংশ সব্জিই নরম অবস্থায় তুলতে হয়। চাষীদের একটা ভুল ধারণা আছে যে, ভিতরের বীজ একটু পুষ্ট হওয়ার পর সিম, বেগুন, লাউ, ঝিঙ্গে, ঢেঁড়স প্রভৃতি তোলা উচিত। এতে ফলন বাড়ে, এ ধারণা ঠিক নয়। নারকেলকে ঝুনো পাকা না করে ডাব অবস্থায় পাড়লে ফলের সংখ্যা যে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়- এ কথা সবারই জানা। সব্জির ক্ষেত্রেও তাই। এভাবে শুধু যে ফলের সংখ্যা বাড়ে-তাই নয়, মোট ফলনও বেশি হয়।
তাছাড়া, বাজারে নরম সব্জির দামও বেশি পাওয়া যায়। তাই লাভটা হয় দুদিক দিয়ে, ওজনে এবং দামে। তা বলে কেউ যেন মটরশুঁটি কচি না তোলে অথবা একেবারে শক্ত না করে ফেলে। আবার লঙ্কার ক্ষেত্রে কাঁচা বা পাকা-দুভাবেই তোলা যায়। অর্থাৎ তোলার ব্যাপারটা ফসল অনুসারে ঠিক করে নিতে হবে।
বিশাল ঝুড়িতে ৬০/৭০ কেজি বেগুন, পটল, ঢেঁড়স, ঝিঙ্গে ইত্যাদি ভরে বাজারে পাঠানো হয়। উপরের চাপে তলার ফলগুলো থেঁতলে যায় এবং পঁচে যায় তাড়াতাড়ি। এতে ক্ষতি হয় শুধু ক্রেতা বা বিক্রেতার নয়, এটা জাতীয় ক্ষতিও বটে। বড় ঝুড়িতে প্যাকিং করতে হলে প্রতি স্তরে আমপাতা, কলাপাতা ইত্যাদি বিছিয়ে নিতে হবে।
আজকাল পটল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ফসলকে রঙ্গে চুবিয়ে ঝকঝকে করা হচ্ছে। এসব রং শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। ফসলে রোগ বা পোকার ঔষধ দিলে নির্দিষ্ট সময় পার করে তোলা উচিৎ। না হলে সে সব্জি খেয়ে মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া হবে- অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতি মৃদুভাবে। বেশিদিন এভাবে চলতে থাকলে শরীর মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরষ্কার (স্বর্ণপদক ১ম) প্রাপ্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন