বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যদিও সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পেজে দাবি করেছে, তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। বিবিসি বাংলায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
একই সাথে তারা জানিয়েছে, ‘সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চীন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।’
কেএনএফ-এর ফেসবুক পেজে ও ইউটিউবে বেশকিছু ভিডিওতে সামরিক ট্রেনিংসহ কার্যক্রমের সচিত্র বর্ণনা দেয়া হয়েছে। র্যাবের দাবি, এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরের কোনো ছবি বা ভিডিও নয়।
বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে কেএনএফ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এগুলো আমরা দেখেছি। সম্ভবত এগুলো আমাদের দেশের না। অভিযান যদিও চলছে। গোয়েন্দারা এগুলো নিয়ে কাজ করছে।’
কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বমের নাম গণমাধ্যমে এসেছে। র্যাব মুখপাত্র বলেন, এ বিষয়েও গোয়েন্দারা কাজ করছে।
র্যাবের অভিযোগ, কিছু তরুণকে সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ও রসদ যোগাচ্ছে এই কেএনএফ। ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে এবং বাকীদেরও আটক করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে র্যাব।
ইতোমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করতে যাওয়া ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে র্যাব। যারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সাথে জড়িত বলা হচ্ছে। র্যাবের দাবি, এদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও এই কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের কারণে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণ আপাতত নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
কেএনএফ কারা, কী চায় তারা
কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবেও প্রচার করছে অনেকে।
গত এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করে তারা।
ওই সময়ে তাদের সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করা হয়। বম এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলায় তার বাড়ি বলে জানা গেছে।
তার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো এমন অন্তত দু'জন জানান, একসময় তিনি নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নে কাজ শুরু করলেও গত কয়েক বছর ধরে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের প্রচার বিভাগের সদস্য দিপায়ন খীসা বলেন, পাহাড়ের একটি বিশেষ প্রভাবশালী মহল এই কেএনএফকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে। কথিত কেএনএফ ফেসবুক পেজে ঘোষণা দিয়ে তাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
বান্দরবানের মানবাধিকার কর্মী লেলুং খুমী বলেন, কয়েক মাস ধরেই পিছিয়ে পড়া এলাকায় কেএনএফের কিছু তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে বলে মনে হয়নি। তাদের কিছু অর্জন করতে হলে সেটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই করতে হবে।’
সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেজে কেএনএফ হেডকোয়ার্টার্সের তথ্য ও ইনটেলিজেঞ্চ ব্রাঞ্চের লেফটেন্যান্ট পাবিক বলেন, ‘কেএনএফ সুশৃঙ্খল সশস্ত্র সংগঠন। কেএনএফ আজ পর্যন্ত একজন বাঙালিকে হত্যা করা তো দূরের কথা, গলা ধরে ধাক্কা পর্যন্ত দেয়নি। আর জেএসএস সশস্ত্র বাহিনী ব্যতিরেকে কোনো নিরীহ চাকমা-মারমা ও ত্রিপুরাকে হত্যা করেনি।’
তাদের ফেসবুক পেজে সামরিক পোশাক পরিহিত নারী পুরুষের ছবি ছাড়াও ট্রেনিং করার কিছু চিত্র দেয়া হয়েছে। যদিও এসব ভিডিও বা ছবি বাংলাদেশের নয় বলেই মনে করছে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ফেসবুক পেজে যা বলেছে কেএনএফ
গত ৮ সেপ্টেম্বর এক পোস্টে কেএনএফ বলেছে, কুকি-চীন জনগোষ্ঠীরা সার্বিক উন্নয়নে সরকার থেকে অন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতো তেমন কোনো সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধা পায়নি। তবে স্বীয় প্রচেষ্টায় দেশকে উন্নয়নের দিকে সবসময় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কুকি-চীন জনগোষ্ঠীরা কখনো কোনো দিন সরকার পরিপন্থী বা ভূখণ্ডের জন্যে হুমকি এমন কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল না।
অবশ্য এর আগেই তারা জানিয়েছিলো, তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে। যার নামহেড হান্টার কমান্ডো টিম।
গত ২২ আগাস্ট সামরিক পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তির পেছন দিক থেকে তোলা একটি ছবি পোস্ট করে কেএনএফ তাকে কুকি-চীন আর্মি হিসেবে উল্লেখ করে। কেএনএফেরই একটি অংশ হলো কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএ।
ওই পোস্টেই বলা হয়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কেএনএফ- এর দাবি মেনে নিন।’
এর এক সপ্তাহ আগে আরেকটি পোস্টে কেএনএফ জেএসএস নেতা সন্তু লারমার তীব্র সমালোচনা করে। ৫ আগাস্ট রেংতলাং রেঞ্জে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে এরা তাদের কমান্ডো।
ফেসবুকেই জুলাই মাসের শেষ দিকে কেএনএফ জানায়, তাদের আরেকদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে।
এর আগে জুন মাসে নারী কমান্ডোদের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছিলো কেএনএফের ফেসবুক পেজে। তবে ২৮ মে তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যের একটি মানচিত্র প্রকাশ করে তারা স্থানীয়ভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।সূত্র : বিবিসি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন