ধান-গম ভুট্টার মতো খাদ্যশস্যের বাইরে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে সব্জি অন্যতম ভূমিকা রাখে। গত দু’-তিন দশকে বাংলাদেশের চাষি ও কৃষি উদ্যোক্তা-খামারিরা ধান উৎপাদনে একটি অভাবনীয় বিপ্লব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। ধান উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে পোল্ট্রি, মৎস্য, গবাদিপশু উৎপানও বেড়েছে সমান তালে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সব্জি উৎপাদন। গত এক যুগে দেশে বিভিন্ন ধরনের সব্জির উৎপাদন অন্তত পাঁচগুণ বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। ট্রাডিশনাল দেশীয় শাক-সব্জির পাশাপাশি বেশকিছু বিদেশি সব্জি উৎপাদনেও চমৎকার সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে আমাদের চাষিরা। এক সময়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা মাশরুম, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি ও স্কোয়াশ অভিজাত রেস্টুরেন্টের চাহিদা পূরণে আমদানি করা হলেও এখন এসব সব্জি দেশেই প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ হচ্ছে। একইভাবে স্ট্রবেরি, ড্রাগনফল, নতুন নতুন জাতের আম, কমলা, সউদি খেজুর, শাম্মাম, মালটাসহ বিদেশি জাতের অনেক ফল চাষেও আমাদের কৃষিবিদরা সাফল্য দেখাচ্ছেন। কয়েকমাস আগে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে পুষ্টি নিরাপত্তা বিষয়ক এক সেমিনারে উপস্থাপিত তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে সব্জি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। শতকোটি মানুষের দেশ চীন ও ভারতের পরই সব্জি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৯ লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে শতাধিক প্রকার প্রায় ২ কোটি মেট্রিক টন সব্জি উৎপাদনের তথ্য জানা যায়। সব্জির উৎপাদন বৃদ্ধি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার মধ্যে আগামী বছর বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মতো জনবহুল দেশকে খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও সারের সংকট যেন দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে না দেয়, সেদিকে এখনই নজর দিতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে তা দেশের জন্য বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। হাওর-বাওর, চরের নতুন জমি এবং বাড়ির আশপাশ-আঙ্গিনাসহ যে সব জায়গায় ধান, আলু বা অন্যান্য ফসলের পরিকল্পিত চাষাবাদ সুবিধাজনক নয়, সে সব জমিতে সহজেই কচু, লাউ, কুমড়া, বেগুন, শিম, শসা, ধুন্দল, চিচিঙ্গা ইদ্যাদি চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিক্রি করেও লাভবান হওয়া যায়। এভাবেই প্রতি বর্গফুট পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে মওসুমী ও শীতকালীন সব্জি চাষের গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে এখন আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে সারাবছর নানা জাতের সব্জি চাষের উপর বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।
খাদ্যশস্য ও সব্জি উৎপাদনে আমাদের কৃষকদের অভাবনীয় সাফল্য কৃষক সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। উৎপাদন খরচের নিরিখে কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও শহরের বাজারে ভোক্তাদের উচ্চমূল্যে সব্জি কিনতে হয়। উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনের মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাবাজির শিকার হচ্ছেন উৎপাদক কৃষক এবং সাধারণ ভোক্তারা। পচনশীল শাকসব্জির সহজ সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করা গেলে সব্জির মূল্যে স্থিতিশীলতা ও ন্যায্যতা রক্ষা করা সহজ হতো। মওসুমে যে টমেটো বা সিম ১৫-২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়, বর্তমানে তা ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূল্য না পাওয়ার কারণে মূল্যবান প্রচুর সব্জি ও ফল খামারেই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। সব্জি বাজারজাতকরণে রাস্তার ধকল, যানজট এবং পথে পথে চাঁদাবাজির মতো বিড়ম্বনা দূর করতে হবে। সেই সাথে সব্জি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণনের আধুনিক প্রক্রিয়ার দিকে নজর দিতে হবে। দেশ থেকে সারাবছরই কিছু সব্জি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। আলু, টমেটো, কপি, মিষ্টি কুমড়াসহ মওসুমের উদ্বৃত্ত সব্জি বিদেশে রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেই সাথে সব্জির বহুমুখী ব্যবহারসহ খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ-বিপণন বিভাগ, খাদ্য অধিদফতর ও নিরাপদ খাদ্য বিভাগের কর্মক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। সব্জি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে এর সঠিক সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সব্জি উৎপাদক কৃষকদের সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন