প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে প্রি-টার্ম বেবি হিসেবে। গর্ভকালীন অবস্থায় সাঁইত্রিশ সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে যে সব শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে তাদের প্রি-টার্ম বেবি হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রি-টার্ম বার্থের কারণে প্রতি বছর সারা বিশ্বে অনেক শিশু মৃত্যুবরণ করে থাকে। সাধারণত গর্ভকালীন অবস্থার সাঁইত্রিশ থেকে চল্লিশ সপ্তাহ সময়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে ফুল-টার্ম ধরা হয়। বত্রিশ থেকে সাঁইত্রিশ সপ্তাহের মধ্যে শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাদের মডারেট বা লো-প্রি-টার্ম বেবি হিসেবে গণ্য করা হয়। আটাশ থেকে বত্রিশ সপ্তাহের মধ্যে শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাদের ভেরি-প্রি-টার্ম অথবা এক্সট্রিম প্রি-টার্ম বেবি হিসেবে গণ্য করা হয়।
গর্ভকালীন সময়ে মাড়ি রোগে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। মাড়ি রোগের কারণে গর্ভবতী মায়ের অকাল প্রসব এবং কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। কম ওজনের শিশু অর্থাৎ আড়াই কেজি ওজনের চেয়ে কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর ওজন কমপক্ষে আড়াই কেজি অথবা তার চেয়ে বেশি হয়। মাড়ি রোগ থাকলে অনাকাক্সিক্ষত এবরশন হতে পারে। নির্ধারিত সময়ের আগে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের দাঁত দেরিতে উঠতে পারে। দাঁতের রঙের পরিবর্তন আসতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে সব ব্যাকটেরিয়া মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি করে থাকে সে সব ব্যাকটেরিয়া রক্ত প্রবাহে মিশে যেতে পারে এবং ফিটাসকে আক্রান্ত করতে পারে। এর ফলে প্রি-টার্ম বেবি বা অকাল শিশু এবং লো-বার্থ ওয়েট বেবি বা কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে।
একটি সম্ভাব্য মেকানিজম বা পদ্ধতি আরম্ভ হয় এন্ডোটক্সিন এর মাধ্যমে যা গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দেখা যায় পেরিওডন্টাল সংক্রমণে। এই এন্ডোটক্সিনগলো সাইটোকাইন উৎপাদন করার জন্য উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন দেয়। সাইটোকাইনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারলিউকিন ১, ইন্টারলিউকিন ৬, টিএনএফ আলফা, প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন উল্লেখযোগ্য। এই সাইটোকাইনগুলো পরিমাণ মত উৎপন্ন হয়ে প্রসবে উদ্দীপনা দিয়ে থাকে। এছাড়া প্রদাহজনক মেডিয়েটরস্ প্লাসেন্টা ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে এবং ভ্রুণের বিষাক্ততা বা ফিটাল টক্সিসিটি সৃষ্টি করে যার কারণে প্রি-টার্ম ডেলিভারি অর্থাৎ প্রসব হতে পারে। শুধু তাই নয় শিশু কম ওজনের হতে পারে। অধিক পরিমাণে সাইটোকাইনগুলো ইউটেরাইন মেমব্রেনকে রাপচার বা ফাটিয়ে প্রি ম্যাচিউর বার্থ করতে পারে। প্রি ম্যাচিউর বার্থ বা জন্ম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রি ম্যাচিউর বা প্রি-টার্ম বার্থ বেবি জন্ম নিলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়। বারবার সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। ডেলিভারির সময় শিশুর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। হাইপোথারমিয়া দেখা দিতে পারে। কারণ ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস যেহেতু ঠিকভাবে গঠন হয় না তাই শরীরের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী স্থান হলো হাইপোথ্যালামাস। সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কম থাকায় শিশুর জন্মের সময় নিওন্যাটাল সেফটিসেমিয়া, নিওন্যাটাল জন্ডিস দেখা দিতে পারে। নবজাতকের ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। তাই শিশু ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। প্রি-টার্ম বেবি যদি বেঁচে থাকে তাহলে পরবর্তী সময়ে হাইপারটেনশন, কানে কম শোনা, ডায়াবেটিস এবং পড়াশোনায় অমনোযোগী হতে পারে। রেটিনোপ্যাথি দেখা দিতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের শেখার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি প্রাপ্তবয়ষ্কদের মুখে থাকতে পারে। প্রদাহজনিত পেরিওডন্টাল টিস্যু উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেরিওডন্টাল সাইটোকাইনস উৎপাদন করে প্রধানত ইন্টারলিউকিন ১, ইন্টারলিউকিন ৬,প্রেস্টাগ্ল্যাডিন ই২, টিউমার নেকরোসিস ফ্যাক্টর টিএনএফ আলফা যাদের সিস্টেমিক কার্যকারিতা রয়েছে হোস্টের উপর। পেরিওডন্টাইটিস সিস্টেমিক প্রদাহ শুরু করে। এটি মনিটর করা যায় কিছু মার্কার দ্বারা যেমন- সি রি-অ্যাকটিভ প্রোটিন অথবা ফিব্রিনোজেন লেভেল দ্বারা। ফিব্রিনোজেন এবং সি রি-অ্যাকটিভ প্রোটিনকে প্রদাহের মার্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাড়ি রোগে কারো জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই রক্তের সি রি-অ্যাকটিভ প্রোটিন এবং ফিব্রিনোজেন এর পরিমাণ দেখে নেওয়া উচিৎ। ইনজুরি, সংক্রমণ এবং প্রদাহতে ফিব্রিনোজেন লেভেল বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
গর্ভকালীন অবস্থায় হরমোনের তারতম্যের জন্য মাড়ি থেকে রক্তপাত, মাড়ি লাল হয়ে যাওয়া, মাড়ি ফুলে যাওয়া, ইপুলিস ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে গর্ভকালীন অবস্থায় যত্নসহকারে দাঁতের স্কেলিং করে নিলে গর্ভকালীন জটিলতা শতকরা ৭০ ভাগ কমে যায়। ফলে প্রি-টার্ম বেবি অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশু জন্মগ্রহণ করার হার অনেক কমে আসবে। শুধু তাই নয় কম ওজনের শিশুও জন্মগ্রহণ করবে না। তাই মাড়ি রোগকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কারণ মাড়ি রোগের জটিলতার কারণে একজন নারীর অথবা একটি পরিবারের বিরাট সমস্যা দেখা দিবে। গর্ভকালীন সময়ের মধ্যে স্কেলিং করানোর জন্য কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় না। গর্ভকালীন সময়ে মাড়ি ফুলে গেলে ভিটামিন সি সেবন করা যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিডের অভাবে ঠোঁট কাটা এবং তালু কাটা শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। শুধু তাই নয় মুখ এবং মাড়িতে আলসার দেখা দিতে পারে। তাই গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই ফলিক এসিড প্রদান করতে হবে। মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে গর্ভাবস্থায় সকালে নাস্তার পর এবং রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করতে হবে। সঠিকভাবে মাড়ির যত্ন নিলে মাড়ির জটিলতা সৃষ্টি হবে না। ফলে প্রি-টার্ম বার্থ এবং লো-বার্থ ওয়েট বেবি জন্মগ্রহণ করবে না। সাধারণ জনগণের এসব বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
ডাঃ মোঃ ফারুক হোসেন
ইমপ্রেস ওরাল কেয়ার
বর্ণমালা সড়ক, ইব্রাহিমপুর, ঢাকা।
মোবাইল ঃ ০১৮১৭৫২১৮৯৭
ই-মেইল ঃ dr.faruqu@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন