বিদ্যুৎ হচ্ছে সভ্যতার প্রাণ এবং উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করেই আধুনিক সভ্যতা নির্মিত হয়েছে, অগ্রসর হয়েছে এবং টিকে আছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কার এবং এর ব্যবহার বিদ্যুতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ ছাড়া উন্নয়ন এবং শান্তি কোনটাই সম্ভব নয়। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানায় উৎপাদন হয় না, কৃষকের মোটর চলে না, অফিস আদালত চলে না, হসপিটালে চিকিৎসা হয় না, গবেষণাগারে গবেষণা চলে না, ছাত্রদের লেখাপড়া চলে না, প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না এবং নাগরিক জীবনে স্বস্তি থাকে না।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানির পরিমাণ কমে যাবে। ফলে রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। আবার বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের গতি কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। বর্তমানে দেশে বিদ্যমান মোট বিদ্যুতের ৪৩ % গৃহস্থালিতে, ৪০.৮ % কলকারখানায়, ১০.৯ % বাণিজ্যিক খাতে, ২.৭ % কৃষিখাতে এবং বাকি ২.৬ % বিবিধ খাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে গড়ে ১৪০০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ১২০০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় গড়ে ২০০০ মেগওয়াট, যার কারণে লোডশেডিং হচ্ছে নিয়মিত। এর পরিমাণ কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। কখনো কখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কিছুটা বাড়লে লোডশেডিং কমে আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কমলে লোডশেডিং বাড়ে। আমদানিকৃত বিদ্যুৎসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের দৈনিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৫০০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১১৬০ মেগাওয়াট আমদানি হয়, ৯১২ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদিত হয় এবং ২৮০০ মেগাওয়াট বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্যাসের সাহায্যে ক্যাপটিভ পাওয়ার নামে উৎপাদিত হয়। দেশের অনেকগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র অনাধুনিক এবং বহু বছরের পুরানো হবার কারণে এগুলো কর্মদক্ষতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এইসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে প্রায় সময় কোনো না কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই থাকে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস তো পায়, এমনকি অনেক সময় কোনো কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া জ্বালানি সঙ্কটের কারণে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ফলে উৎপাদন কমে গেছে এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী এবং বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিদ্যুৎ এমন একটি জিনিস, যেটা কখনো জমা করে রাখা যায় না। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য বর্তমানে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মজুদ করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ মজুদের কোনো পন্থা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেনি, অদূর ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো পন্থা আবিষ্কারের সুযোগ নেই। তাই যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, সে পরিমাণে বিদ্যুতের যোগান দেয়া হয়। আর যখনই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হয় তখনই লোডশেডিং শুরু হয়। চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান যত কম লোডশেডিংয়ের পরিমাণও তত কম। অপরদিকে চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান যত বেশি লোডশেডিংয়ের পরিমাণও তত বেশি। সুতরাং লোডশেডিং কমাতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এটাই একমাত্র সমাধান। বিদ্যুতের চাহিদা সবসময় ক্রমবর্ধমান এবং চাহিদা বৃদ্ধির এ হার সময়ের সাথে সাথে সবসময় ঊর্ধ্বমুখী এবং এটা স্থায়ী। কারণ, প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘরবাড়ি, অফিস আদালত তৈরি হচ্ছে এবং এখানে বিদ্যুতের নতুন চাহিদা বাড়ছে। একইভাবে প্রতিদিনই নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে ব্যাপক পরিমাণে বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিনই কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা এবং বিদ্যুতের সংযোগ বাড়ছে। কিন্তু প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে না।
সময়ের চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধান করতে হলে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত সকল বিদ্যুতকেন্দ্রকে উৎপাদনে আনতে হবে। তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ কেন্দ্রগুলোকে মেরামত করতে হবে। জ্বালানি সমস্যার কারণে যে সব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, সেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বাালানি সরবরাহের মাধ্যমে চালু করতে হবে। এসবের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। পাওয়ার গ্রিড কো¤পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি ) দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে। আধুনিক বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পিজিসিবিকে কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত সকল বিদ্যুৎ যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিতরণ করা যায় তার জন্য আধুনিক বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলোর নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করে উৎপাদনে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে বড় বড় উৎপাদন ক্ষমতার যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে এর মধ্যে ১৩২০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, ১৩২০ মেগাওয়াটের এস এস পাওয়ার প্রকল্প, ২৪০০ মেগাওয়াটের রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প অন্যতম। বিশেষ পদক্ষেপ নিলে এসব প্রকল্পের কাজ দ্রুত সময়ে শেষ করা যাবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা যাবে। এছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য যে চুক্তি হয়েছে, তা চুক্তি অনুসারে সঠিক সময়ে যাতে আমদানি হয় সে ব্যাপারে মনিটরিং বাড়াতে হবে। এসব কাজে যত অর্থই ব্যয় হোক না কেন, তা আমাদেরকে করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য সেক্টরে কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এসবের পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আরো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সৌর বিদ্যুৎ ঊৎপাদনের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই যদি বাড়ির ছাদে একটি করে সৌর বিদ্যুৎ ঊৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করি তাহলে বাড়ির প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ আমরা নিজেরাই যোগান দিতে পারব। তখন বিদ্যুৎ সেক্টরে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। তার জন্য সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির যোগান ও কারগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং শহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ দিতে হবে।
বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি, বিদ্যুতের অপচয় এবং অপব্যবহার রোধ করতে হবে। বিদ্যুতের অপচয় এবং অপব্যবহার রোধ করার মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি রোধ করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো কমে যাবে। সুতরাং বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধানে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় সমস্যা। এটা কোনো বিশেষ গোষ্ঠির সমস্যা নয়, বরং এটা আমাদের সবার সমস্যা। কাজেই, জাতীয়ভাবেই এর সমাধান দ্রুতায়িত করতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন