বস্ত্র শিল্পে বাংলাদেশ দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। বিগত দুই দশকে এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বস্ত্র রফতানি করছে। করোনার সময় ঝুঁকিতে পড়লেও এ শিল্প এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে এখন এ শিল্পের গোটা সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রয়োজনীয় গ্যাস ও বিদ্যুতের (ঘন ঘন লোডশেডিং) অভাবে এসব কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। শুধু তাই নয় গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে ৯০ শতাংশ বস্ত্রকলে উৎপাদন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। গতকাল এ সেক্টরের ব্যবসায়ীরা উৎপাদন বিঘ্নের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে জানায়, টেক্সটাইল মিল মালিকরা চতুর্মুখী সঙ্কটে আছে। একদিকে অর্ডার সঙ্কট। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে চাপ দিচ্ছে, গ্যাস সঙ্কট। দিনের বেশির ভাগ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। জ্বালানির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠা এ শিল্প এখন জ্বালানির সঙ্কটের কারণেই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
জ্বালানি সঙ্কটে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে স্পিনিং শিল্প বা বস্ত্র খাতের উৎপাদন। বিশেষ করে গ্যাস-সঙ্কটের কারণে বস্ত্র খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ পেট্রোবাংলা আশ্বস্ত করেছিল অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। নভেম্বরে আরো ভালো থাকবে। ডিসেম্বরে কোনো সঙ্কট থাকবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নতি তো দূরে, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আগামী দুই মাসে গ্যাসের সঙ্কট আরো বাড়বে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। আর তাই এই খাতের ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক থাকলেও ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই ভালো নেই। প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও গ্যাস সঙ্কটে দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়ে আড়াই ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। উৎপাদন এখন তলানিতে। এতে বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েছে তাঁত ও বস্ত্র শিল্প। ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সঙ্কট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে না পারলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে এ অবস্থা তৈরি হতো না। একই সঙ্গে কাপড় রং করার ডাইং কারখানাগুলোও লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে গাজীপুর ও নরসিংদীর শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। উৎপাদন কমেছে প্রায় ৬০ ভাগ। হুমকির মুখে পড়েছে ১ কোটি ৬০ হাজার ডলারের বিনিয়োগ। ১০ লাখ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উৎপাদন করা না গেলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কাও তীব্র হবে। দেশ আবারো আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে পুরো অর্থনীতি চাপে পড়বে।
অবশ্য বস্ত্র খাতে এই সঙ্কটের শুরু গত মার্চ থেকে। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, আশুলিয়া, ভালুকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদীর মাধবদী, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এসব এলাকায় গ্যাসের অবস্থা খুব নাজুক। কোথাও সন্ধ্যা ৫টা বাজে গ্যাস চলে যায়, আসে পরের দিন সকাল ৫টায়। এতে করে কারখানাগুলো উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। সক্ষমতার বাকি ৬০-৭০ শতাংশই উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ আশঙ্কার কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ সহসভাপতি ফজলুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, পরিচালক মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লাহ জোবায়ের, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মোনালিসা মান্নান প্রমুখ। মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সঙ্কট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকেরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে। জ্বালানির সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো যদি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতো, তাহলে বর্তমান অবস্থা তৈরি হতো না। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলা আমাদের আশ্বস্ত করেছিল, অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। নভেম্বরে আরো ভালো থাকবে। ডিসেম্বরে কোনো সঙ্কট থাকবে না। কিন্তু উন্নতি তো দূরে, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আমাদের শঙ্কা, আগামী দুই মাসে গ্যাসের সঙ্কট আরো বাড়বে। মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, নিট পোশাকের ৮০ ভাগ কাঁচামালের যোগান দেয় স্থানীয় স্পিনিং শিল্প। গেল বছরেই এই খাত থেকে যোগান দেয়া হয় ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড়। যার আনুমানিক দাম ৮ বিলিয়ন ডলার। তাই এই শিল্পখাতকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। বেশ কয়েক দফায় সরকারের শীর্ষ মহলে তাগিদ দিয়েও সঙ্কটের উত্তরণ হয়নি বলে জানান বিটিএমএ সভাপতি। এক্ষেত্রে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি। তিনি বলেন, টেক্সটাইল মিল মালিকরা চতুর্মুখী সঙ্কটে আছে। একদিকে অর্ডার সঙ্কট। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে চাপ দিচ্ছে, গ্যাস সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ১০-১২ ঘণ্টা কারখানা চালু রেখে শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে অনেক শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে ১৬ বিলিয়ন ডলারের এ শিল্প টিকে থাকবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আক্ষেপ করে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দেশে শিল্পের কোনো কাঁচামাল উৎপাদন হয় না। একমাত্র কাঁচামাল আছে- জ্বালানি। এ জ্বালানির ওপর নির্ভর করেই শিল্প গড়ে উঠেছে। উদ্যোক্তারা একের পর এক শিল্প স্থাপন করেছে। এখন জ্বালানির সঙ্কটের কারণেই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের দূরদর্শিতার অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কি-নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, এ অবস্থার পেছনে কার দোষ বা দূরদর্শিতা অভাব তা বলতে চাই না। তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে প্রতিদিন ৫০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন কিউবিক ফিট) এলএনজি আসার কথা থাকলেও ৩৬০ এমএমসিএফ গ্যাস আসছে। বাকি ১৪০ এমএমসিএফ গ্যাস আসলে অন্তত গাজীপুর এলাকায় শিল্পের গ্যাস স্বাভাবিক রাখা যেত। কেন ১৪০ এমএমসিএফ গ্যাস আসছে না, কার ভুলে এটি হয়েছে?
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাস সঙ্কট দ্রুত সমাধানের জন্য স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে হবে। প্রয়োজনে সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ রাখা উচিত। কারণ রফতানি ও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। রফতানিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডলার সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২ লাখ ডলারের গ্যাসের পেছনে খরচা করলে ৪৮ লাখ ডলার আয় করা সম্ভব। তাই দ্রুত গ্যাস সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগী হওয়া উচিত।
অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে, নানা সঙ্কটে দেশীয় তাঁত শিল্প অনেকটা বিলুপ্তির পথে। বর্তমান জ্বালানি সঙ্কটে বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছে শিল্পটি। এমনকি অস্তিত্ব ধরে রাখার শঙ্কায় আছেন মিল্প মালিকরা। অথচ এখনো মহামারি করোনার ক্ষতি কাটিয়েই ওঠতে পারেনি শিল্প মালিকরা। তাই এক সঙ্কট যেতে না যেতে আবার নতুন সঙ্কট দেখা দেয়ায় ব্যাংক ঋণের সুদের চাপ মাথায় নিয়ে অনেক ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যারাও টিকে আছে তাদের অনেকই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। অনেক মালিক নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকগুলো মর্গেজ হিসেবে রাখা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে তুলছে। অবশ্য ব্যাংকগুলোর এ নিয়ে কিছু করার নেই। ঋণখেলাপি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে এটাই বাস্তবতা। নরসিংদীর সূচনা টেক্সটাইল মিলের মালিক নারী উদ্যোক্তা ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, করোনাকালীন সময়ে মিল বন্ধ ছিল, বিধায় বস্ত্র উৎপাদনকারী সকল মিল-কারখানা ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন আবার নতুন করে লোডশেডিং-এর জন্য কারখানা বন্ধ, শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক সুদের চাপ সামাল দিতে না পেরে অনেকে ধার-দেনা ও জমি বিক্রি করে সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
এদিকে ইনকিলাবের নরসিংদী সংবাদদাতা মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, নরসিংদী সদর উপজেলা মাধবদী, শেখেরচর বাবুরহাট তাঁত ও বস্ত্র শিল্প উৎপাদন এলাকা নামে খ্যাত। এখান থেকে প্রায়ই দেশের ৭৫ ভাগ বস্ত্রের চাহিদা পূরণ করা হয়। দেশিয় তাঁত অনেকটা বিলুপ্তির পথে। তাই ভিনদেশিদের সাথে পাল্লা দিয়ে গুণগতমানের কাপড় তৈরিতে তারাও সচেষ্ট। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লোডশেডিং-এর ফলে ক্ষতির সম্মুখীন ও অস্তিত্ব ধরে রাখার শঙ্কায় আছেন ঐতিহ্যবাহী এই তাঁত ও বস্ত্র শিল্প। গত করোনাকালীন কলকারখানা মালিকদের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা আরো অনেক সময়ের ব্যাপার। ব্যাংক ঋণের সুদের চাপ মাথায় নিয়ে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর বেশিরভাগ ফ্যাক্টরি রয়েছে ঋণখেলাপির তালিকায়। অনেক ফ্যাক্টরি মালিক নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। যেমন ব্যাংকে মর্গেজ হিসেবে দেয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ব্যাংক কর্তৃক নিলামে তোলার প্রক্রিয়া চলছে।
একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, লোডশেডিং অথবা যে কোনো কারণে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকুক বা চালু থাকুক এটা ব্যাংকের দেখার বিষয় নয়। গ্রাহক ঋণখেলাপি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য। সরেজমিনে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুতের জন্য ফ্যাক্টরি বন্ধ। বিভিন্ন মিলে শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যুতের কারণে মিল ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় মালিকরা আমাদের বেতন দিচ্ছে না। বাড়ি ভাড়া দিতে পারতেছি না, পরিবারের লোকজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। আর কিছুদিন এমনভাবে চলতে থাকিলে আমরা না খেয়ে মারা যাব।
নরসিংদী জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. ইউসুফ বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের চরম ভোগান্তির প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যুতের এই সমস্যা জাতীয় পর্যায়ে, শুধু নরসিংদীতে নয়। তবে সরকারের নির্দেশনা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, আশা করা যায় কিছু দিনের মধ্যে বিদ্যুতের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন