বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গ্যাস-বিদ্যুতে মূল্যবৃদ্ধি আলোচনায়

ফিরে দেখা ২০২২

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১১:৫২ পিএম

গত বছর জুড়ে, ঘন ঘন লোড শেডিং, জ্বালানি তেল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক আলোচিত ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে হয়। লোকসান কমাতে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেন ৮৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা হয়। দাম বাড়ানোর ২৩ দিনের মাথায় এসব জ্বালানি তেল লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা কমানো হয়। বছরের শেষ দিকে বিশ্ব বাজারে জ্বালানির দাম কমে আসা, দেশেও সঙ্কট কিছুটা কাটার মধ্যে একেবারে শেষ দিকে পদ্মার ওপার থেকে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র রামপাল ও পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরেছে জ্বালানি খাতে। বিদ্যুতের সাফল্য চাপা পড়ে যায় দেশজুড়ে ব্যাপক লোড শেডিংয়ে। সব মিলিয়ে এ বছর সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী ছিলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার পর দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও বাস্তবে তা এর উল্টো ছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় জুলাই থেকে স্পট মার্কেট খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানি বন্ধ করে সরকার। এতে বেশ কিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক কিছু বিদ্যুকন্দ্রও বন্ধ হয়। এতে গত বছরের টানা পাঁচ-ছয় মাস দেশ লোড শেডিংয়ে বিপর্যস্ত ছিল। রাজধানীতে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৮-১০ ঘণ্টা লোড শেডিং ছিল। গ্রাম পর্যায়ে লোড শেডিংয়ের প্রভাব আরো ভয়াবহ ছিল। লোড শেডিংয়ের সময় প্রচণ্ড দাবদাহ থাকায় প্রচণ্ড গরমে বেশ দুর্ভোগ পোহায় দেশের মানুষ। শিল্প-কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হয়। রপ্তানির গতি কমে যায়। বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী হয়ে পড়া জ্বালানির দাম নতুন বছরে গ্যাস সংকটেও সমাধানের পথ খুলে দেবে বলে আশা সরকারের নীতি নির্ধারকরা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে গত বছরের ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে দিনে একবার এক ঘণ্টা লোড শেডিং করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু সূচিভিত্তিক লোড শেডিংয়ের কথা জানানো হলেও তা ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এলাকাভিত্তিক সপ্তাহে এক দিন শিল্প-কারখানাও লোড শেডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সরকারি- বেসরকারি অফিসের কর্মঘণ্টা কমানো হয় এক ঘণ্টা। এত কিছুর পরও কমেনি লোড শেডিং। ঘোষণার সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে কেটে যাবে লোড শেডিং। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত লোড শেডিং ছিল। শীতের আগমনে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কমে যায় লোড শেডিং। ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের অর্ধেক অংশ। কোথাও কোথাও ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। দীর্ঘ সময় টানা বিদ্যুৎহীন থাকায় দুর্ভোগ পোহায় কোটি কোটি মানুষ।

পদ্মার ওপর দিয়ে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন গত ১৫ ডিসেম্বর চালু হয়েছে। গ্রিড লাইনটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দুটি বৃহৎ বিদ্যুেকন্দ্র, ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ঢাকা নগরে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সুবিধা হবে। রামপালের প্রথম ইউনিটের উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৪০০ মেগাওয়াট ঢাকায় সরবরাহ হচ্ছে। বাকিটুকু খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে হয়। লোকসান কমাতে গত বছরের ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেন ৮৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা হয়। দাম বাড়ানোর ২৩ দিনের মাথায় এসব জ্বালানি তেল লিটার প্রতি পাঁচ টাকা কমানো হয়। ৫ জুন পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করেছে বিইআরসি, যা গত জুন মাস থেকে কার্যকর। রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৮০ টাকা। এক চুলার মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা করা হয়েছে। আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ টাকা। ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়েছে ১৯.৯২ শতাংশ। ইউনিটপ্রতি পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ছয় টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। পাইকারিতে দাম বাড়ায় বিতরণ কম্পানিগুলোও গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এ নিয়ে ৮ জানুয়ারি গণশুনানি করবে বিইআরসি।

জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার পর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে। পরিবহন খরচ বাড়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ এই তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় বাসাবাড়িতে রান্নার খরচ ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া এবং স্পট মার্কেট এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় শিল্প-কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সংকটের কারণে কমে গিয়েছিল শিল্প-কারখানার উৎপাদন। এর মধ্যে সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। শীতে বিদ্যুেকন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় গ্যাসসংকট কিছুটা কমেছে। তবে এখনো রাজধানীসহ দেশের কোথাও কোথাও চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্যাস মিলছে না। শিল্প-কারখানাগুলো এখনো তাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না বলে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।

গত বছরের ২১ মার্চ পটুয়াখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের সময় দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা আসে। এ জেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী উপজেলায় নদীর তলদেশ দিয়ে (সাবমেরিন কেবল) বিদ্যুতের বিতরণ লাইন পারাপার করে সেখানে ২৫ হাজার পরিবারের মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জনের কথা জানায় সরকার। আরেক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সন্দ্বীপে একই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত হয়েছে কয়েক বছর আগেই। নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়াতেও স্থাপন করা হয়েছে ১৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এভাবেই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তিকগুলো বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। সরকারি সংস্থা পাওয়ার সেলের হিসাবে, জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে দেশে এখন ৪ কোটি ৩৯ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে ৬০ লাখ আবাসিক গ্রাহক সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিজেদের চাহিদা মেটাচ্ছেন। ২০০৯ সালে গ্রাহকের এ সংখ্যা ছিল এক কোটি ৮০ লাখ। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল পিক টাইমে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ডও করে বাংলাদেশ। ওইদিন এটাই ছিল বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা। বিদ্যুতের এসব ভালো খবরের রেশ খুব বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম চড়তে থাকলে। এতে ডিজেলচালিত ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ করা হলে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য আর ঠিক থাকেনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন