শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধ ও শিক্ষকের দায়বদ্ধতা

ইলিয়াজ হোসেন রানা | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় গ্রিসে। কালক্রমে তার বিস্তার ঘটতে থাকে বিভিন্ন দেশে। শিক্ষার আলোয় সভ্য হতে থাকে মানুষ। বাহ্যিক জগতের মতো তৈরি হয় আরেকটি জগৎ আর সেটা হলো মানুষের মানসজগৎ। এই মানসজগতের ভিত্তিমূলে রয়েছে শিক্ষা তথা জ্ঞানজগৎ। বিশ্বসভ্যতায় তাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এই শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই মানুষ হয়েছে মানুষ। তাই বলা যায়, জগৎসভ্যতার অগ্রগতি ও প্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। বার্ট্রান্ড রাসেল তার শিক্ষা ও সমাজকাঠামো গ্রন্থে শিক্ষার তিনটি তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন। প্রথম তত্ত্বানুসারে শিক্ষার লক্ষ্য হলো, ক্রমোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা আর উক্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রভাব দূর করা। দ্বিতীয় তত্ত্বানুসারে শিক্ষার লক্ষ্য, প্রতিটি ব্যক্তিকে সংস্কৃতিবান করে তোলা এবং ব্যক্তির দক্ষতার সবোর্চ্চ বিকাশ সাধন করা। তৃতীয় তত্ত্ব মতে, শিক্ষার লক্ষ্য, বিছিন্ন ব্যক্তি নয়, গোটা সম্প্রদায় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে কেজো নাগরিক তৈরি করা। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার শিক্ষার লক্ষ্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষ স্বভাবতই দ্বিজ, অর্থাৎ শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই মানুষ দ্বিতীয় বার জন্মগ্রহণ করে। সে নিজেই নিজেকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা রাখে’। এরিস্টটল বলেছেন, মৃত ও জীবিতের মধ্যে যা তফাৎ শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে তা-ই তফাৎ। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কোরানের প্রথম শিক্ষা ‘পড়ো! তোমার সেই রবের প্রতি যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চিনে যেতে হলেও যাও’। তিনি জ্ঞান অর্জনকে প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সভ্যজগতেও শিক্ষাকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রত্যেক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৪৯ এবং ১৯৭১ সালের পর যথাক্রমে চীন ও রাশিয়ার পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থাকে সংহত করার কাজে শিক্ষাই সাহায্য করেছে। আবার ১৯৯১-৯২ সালে রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় যে রূপান্তর এসেছে তাকে সংহত করার কাজে শিক্ষাই ধাত্রীমাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ইরানের সমাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্য হলো ইসলামিক মূল্যবোধে জনগণকে দীক্ষিত করে তোলা। এজন্য তারা ইসলামিক ভাবধারা প্রভাবিত শিক্ষাতত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ভারতের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বর্তমান বিশ্বে মানুষের উন্নতি, কল্যাণ ও নিরাপত্তার মাত্রা কেবল শিক্ষাই নির্ধারণ করতে পারে।

মূল্যবোধ বলতে বলা যেতে পারে, এটি এমন বোধ বা উপলদ্ধি, যা মানুষকে ভালো, সত্য, ন্যায় প্রভৃতিকে গ্রহণ করতে শেখায়। এটি একদিকে আমাদের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, তেমনি উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্বে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ মানব আচরণের নির্ধারক। ব্যক্তিক ও সামজিক উভয় জীবনেই এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ মানুষের আচরণের স্থায়ী মানদন্ড তৈরি করে। আমরা বর্তমানে পরস্পরবিরোধী বা স্ব-বিরোধী একটি পৃথিবীতে বাস করছি। এ পৃথিবীতে একদিকে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্রুত এগিয়ে চলছে, অন্যদিকে তেমনি বেশির ভাগ সমাজই নৈতিক, মানবিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত সমস্যায় মুখোমুখি হচ্ছে। পৃথিবী জুড়েই প্রত্যাশিত মানবিক মূল্যবোধের একরকম বিলুপ্তি লক্ষ্যণীয়। স্নেহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আতিথেয়তা সৌজন্যবোধ, সততা, শ্রদ্ধাশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহযোগিতা, বিশ্বস্ততা, বিশুদ্ধতা, ক্ষমাহীনতা, আধ্যাত্মিকতা, নম্রতা, বিনয়, পরার্থপরতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি সর্বজন স্বীকৃত, আকাক্সিক্ষত ও লালিত মূল্যবোধগুলি ভয়ংকর রকমে হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীতে হিংসা, বর্বরতা, দলাদলি, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থপরতা, অতিব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, প্রভৃতি অপত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সমাজকে করেছে কলুষিত।
তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে প্রায়শই আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক শিক্ষক নিগ্রহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী নিগ্রহ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের ঘটনা, পিতা মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা বা সন্তান কর্তৃক পিতামাতা হত্যা, পরকীয়ার জেরে পিতামাতা কর্তৃক সন্তান হত্যা, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দের পারস্পারিক অকথ্য কুভাষণ, দুর্নীতি, ঘুষ, জুলুম, জবর-দখল, বিলাসিতা, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অমানবিক বিষয়াবলী। এমন বাস্তবতায় মূল্যবোধের শিক্ষা খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। বলা যেতে পারে, এটি আধুনিক সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বা প্রয়োজন। মূল্যবোধের এমন সংকটের অন্যতম কারণ হলো, গতানুগতিক ও আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যকার সংঘাত। কেননা আধুনিক যুগ জ্ঞান ও ক্ষমতার যুগ। এ যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্র দ্রুত পরিবর্তনের কারণে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থায় কোনো জ্ঞানই স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ফলে নানবিধ সংকট তৈরির মধ্যদিয়ে মানব জীবন হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন, অস্থিতিশীল, যা থেকে মুক্তির আশা মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। এ সংকট নিরসনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। মূল্যবোধের এই সংকট দূর করতে হলে শিক্ষাকে যুগোপযোগী মূল্যবোধ সৃষ্টির দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষের জীবনের মূল্যবোধগুলি যদি বর্তমান সমাজ জীবনের উপযোগী হয় তবে সংকট নিরসন হবে। এই জন্য উপযুক্ত শিক্ষানীতির মাধ্যমে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষায় আবশ্যিকভাবে প্রকৃত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষক সভ্যতার ধারক। শিক্ষক হবেন মুক্তমনা ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার মূর্তপ্রতীক। এইজন্য শিক্ষককে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ডে শিক্ষার রস সঞ্চালন করে একে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকের প্রথম দায়বদ্ধতা তার পেশার প্রতি সম্যক জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানের অন্বেষণ ও বিতরণের প্রতি অঙ্গীকার, পেশাগত এ দায়বদ্ধতাই একজন শিক্ষককে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় শিক্ষার্থীকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, তাহলে প্রথমে শিক্ষককে হতে হবে একজন আলোকিত মানুষ। শিক্ষকের হাতে থাকতে হবে জ্ঞানের আলোর মশাল, যা তিনি তুলে দেবেন শিক্ষার্থীর হাতে। জ্ঞানের আলোয় শিক্ষক নিজে আলোকিত হবেন এবং সেই আলো দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীকে আলোকিত করবেন, শিক্ষার্থীর চিত্তে আলো জ্বালাবেন। শিক্ষক শুধু মাত্র পাঠ্য বিষয় শিক্ষা দেবেন না। পাঠের মধ্য দিয়ে আনন্দ, ঔৎসুক্য, জিজ্ঞাসা ও সৃষ্টিশীল সাধনার মনোভাব জাগ্রত করে শিক্ষার বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে সঞ্চারিত করবেন, যা শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি, তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যকে শিক্ষার্থীর জীবনে মূর্ত করে তোলে, যাতে শিক্ষার আলো চারিদিকে প্রবাহিত হয়। শিক্ষকের জ্ঞানের গভীরতা ও শিক্ষাদানের কলাকৌশল শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য যদি হয় শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা, মানব কল্যাণের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলা, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মন ও সাহসী প্রত্যয় সৃষ্টি করা এবং জগতের যা কিছু মহৎ তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা, লোভ লালসা ও ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টি করা, তাহলে শিক্ষকের নৈতিক শক্তি ও নৈতিক গুণাবলী ছাড়া তা শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রবিষ্ঠ করা কখনো সম্ভব নয়।
শিক্ষার কাজ হলো মানুষের মধ্যে নৈতিক চরিত্র গঠন করা। ব্যাপারটি যদি তাই হয় তাহলে শিক্ষা মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সঞ্জীবনীর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। চরিত্র বলতে শুধু নৈতিক চরিত্রকেই বোঝায় না, যে কোনো মানুষের আচার ব্যবহারও তার অন্তর্ভুক্ত। যে মানুষ বিচার বিশ্বাস, সততা ও দক্ষতার উপর নির্ভর পূর্বক প্রতিটি কাজ সম্পাদন করে সেই প্রকৃত চরিত্রবান। শিক্ষার সাহায্যে এ চরিত্র গঠন করা যায়। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতির সাহায্যে ইহলোক ও পরলোকের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ নিজেকে এবং বিশ্বকে জানতে পারে। আর এই মহৎ কাজটার কারিগর হলেন শিক্ষক। তিনি সমাজ গড়ার কারিগর, কিন্তু অতিব পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দোকান, শিক্ষক দোকানদার এবং শিক্ষার্থী খদ্দেরে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক দোকানের পণ্য কেনা-বেচার সম্পর্কের রূপ লাভ করেছে। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে এখানে স্বার্থের যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব হয়, তার ফলে মানুষের বিকাশ কখনো সমভাবে হয় না। বিকাশটা হয় অসম, যার ফলে এই ধরণের শিক্ষার মধ্যে স্বার্থপর মানুষ সৃষ্টি হয়। মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই আজ প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীর নৈতিক জাগরণ। কারণ, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যদি নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ না ঘটে তাহলে তাদের দ্বারা এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা সংগঠিত হবে না। ফলে বৈশ্বিক মানবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন