চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে রাতভর মারপিট করে কাচারি ঘরের সাথে খুঁটিতে বেঁধে রাখেন গ্রামবাসীরা। খবর পেয়ে স্বামীকে বাঁচাতে ওই ব্যক্তির স্ত্রী দ্রুত ছুটে যান কাচারি বাড়িতে। গিয়ে দেখেন স্বামীকে খুঁটিতে বেঁধে রেখে পাহাড়া দিচ্ছেন গ্রামবাসী। এ সময় যন্ত্রণায় কাতর স্বামী বারবার পানি পান করতে চাচ্ছিলেন।
কিন্তু তাকে এক ফোঁটা পানিও পান করতে দেয়া হয়নি। ব্যথার যন্ত্রণায় সারা রাত ধরে ছটফট করলেও নেওয়া হয়নি হাসপাতালে। এমনকি যন্ত্রণা কাতর স্বামীকে হাসপাতালে পাঠানোর স্ত্রীর শত আকুতিও মনে গলাতে পারেনি গ্রামবাসীদের। শেষ পর্যন্ত ভোররাতে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ওই ব্যক্তি।
সোমবার দিবাগত রাতে কুষ্টিয়ার খোকসা ও পাংশা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার মেঘনা গ্রামের কাচারী বাড়ি এলাকায় এই হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে।
নিহত ওই ব্যক্তি ফজল শেখ (৪০) খোকসা উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের সেনগ্রামের মৃত চৌধুরী শেখের ছেলে। দুই সন্তানের জনক ওই ব্যক্তি একজন ভ্যান-সাইকেল মেকার ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করে খোকসা থানা পুলিশ।
পরে সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। নিহতের স্বজনরা জানায়, রাত ৯ টার দিকে মুঠোফোনে কল পেয়ে ফজল বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর রাত একটার দিকে বাড়িতে খবর আসে কাচারী বাড়ির খুঁটিতে বেঁধে গ্রামবাসীরা তাকে মারপিট করছেন। খবর পেয়ে তার স্ত্রী নার্গিস খাতুন দ্রুত কাচারী বাড়িতে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন খুঁটিতে হাত-পা বাঁধা। শুধু পানি পানি করছেন। সেসময় গ্রামবাসী তাকে পানিও দেননি, চিকিৎসাও করায় নি। আবার তাঁর স্ত্রীকেও সেবা যত্ন করতে দেয়া হয়নি। এরপর রাত তিনটার দিকে যখন ফজলের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন এলাকাবাসী চলে যান। ভোর রাতে স্ত্রী তাকে উদ্ধার করে পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। স্বামীর মরদেহটি নিয়ে স্ত্রী নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
স্বজনরা আরো জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে পাংশার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মেঘনা গ্রামের ইরি শেখের স্ত্রী ও আব্দুল কাদের মোল্লার ছোট মেয়ে ইতি খাতুনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ফজল। এই পক্ষের সাত বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তারাই হয়তো ডেকে নিয়ে চোরের বদনাম দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে তারা দাবি করেন।
গ্রামবাসীরা জানায়, সোমবার রাতে এলাকার সামছুলের বাড়িতে কয়েকজন চোর অটো গাড়ির ব্যাটারি চুরি করছিল। এসময় ফজলকে হাতেনাতে ধরে কাচারী বাড়িতে বেঁধে রেখেছিল। এসময় তাকে গণপিটুনিও দেওয়া হয়। হয়তো ভয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
এ বিষয়ে নিহতের স্ত্রী নার্গিস খাতুন বলেন, 'রাতে স্বামীকে কেউ একজন ফোন করে ডেকে নিয়ে যায়। পরে রাত একটার দিকে খবর পেয়ে ছুটে কাচারী বাড়ি গিয়ে দেখি স্বামীকে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বারবার পানি পানি বলে চিৎকার করছে। চারপাশে গ্রামবাসী ভিড় করে আছে। কিন্তু পানি খেতে দেয়নি। আমি পানি দিতে গেলে ও চিকিৎসার কথা বললে আমাকেও মারপিট করে তাঁরা। পরে রাত তিনটার দিকে স্বামী নিস্তেজ হয়ে পড়লে গ্রামবাসীরা চলে যায়। এরপর ভোররাতে পাংশা হাসপাতালে নিলে ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। '
তিনি আরো বলেন, 'ওই এলাকার আবু বক্কর, হোসেন, ইরি, সামছুলরা বেশি মারেছে। ওরা বারবার বলছিল মেরে ফেল ওকে মেরে ফেল। আমার স্বামী একজন মেকার, চোর নয়। তারা পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই। '
এ ব্যাপারে কাচারিবাড়ির মোশারফের ছেলে বিপুল হোসেন বলেন, ' রাতে সামছুলরা চোর ধরেছিল। গ্রামের লোকজন কাঁচারী বাড়িতে বেঁধে রেখেছিল। রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। সকালে শুনলাম স্ট্রোক করে মারা গেছে চোর। '
খোকসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আশিকুর রহমান বলেন, 'মঙ্গলবার সকালে সেনগ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ফজলের মরদেহ উদ্ধার পূর্বক সুরতহাল করে হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। চোর সন্দেহে এলাকাবাসী তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। ' তিনি আরো বলেন, ' ঘটনা পাংশা থানায়। তাই মামলা সংক্রান্ত কার্যক্রম তারা করবেন। তবে এই থানায় ফজলের নামে কোনো চুরি বা অন্য মামলা নেই। '
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন