সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কে এন ডি এর সভাপতি হচ্ছেন- নাথানা লনচেও প্রকাশ নাথান বম (৪৫)। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ২ নং রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেন পাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেও (জুমচাষী) এর পুত্র হচ্ছেন এই নাথান বম। তার মাতা মৃত রৌকিল বম, ছিলেন একজন গৃহিনী। একটি হতদরিদ্র পরিবার থেকে তার উঠে আসা বলা যায়। ৫ ভাই ও ১ বোন এর মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ ভাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সন্তু গ্রুপের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) যোগ দেওয়ার কারণে নাথান বম এর পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় সন্তু লারমা। তার সুবাদে তিনি পড়াশোনা করেছেন- বিএ অনার্স, এম এচারুকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।এইচএসসি করেছেন-১৯৯৫ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো ঢাকা কলেজ।এসএসসি পাস করেন-১৯৯৩ সালে।শিক্ষা বোর্ড ছিল চট্টগ্রাম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বান্দরবান দন বক্স উচ্চবিদ্যালয়।
এছাড়াও তিনি লন্ডন থেকে আর্কিটেকচার বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী ধারী বলে জানা যায়। স্থানীয় অধিবাসীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নাথান বমরা ছিলেন দিনে এনে দিনে খাওয়ার মত পরিবার। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তার বাবার পাশাপাশি ভাইকেও জীবন যুদ্ধে নামতে হয়েছিলো৷ তার বড়ভাই জোয়াম লিয়ান বম (৬২) ছিলেন পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। রুমা বিদ্যুৎ বিভাগের অস্থায়ী কর্মচারি নামেও পরিচিত। চতুর্থ ভাই রপুই বম পেশায় জুম চাষী হলেও সে কেএনএফ সদস্য বলে জানা যায়। নাথান বমদের পরিবার অনেক বড়। পরিবারের এতো সদস্যের আহার যোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, জোন ও বিগ্রেডে সাহায্যের জন্য যেতেন।
সন্তু লারমা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়ার পর এবং পিসিপিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়ার পর তার জীবন ও তার পরিবারের জীবনধারা পরিবর্তন হয়ে যায়৷ পরিবারের অনেক সদস্য সরকারি চাকরি পায় এবং নিজের স্ত্রী লাল সমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে যোগ দেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রীর পাশাপাশি তার দুইটি শিশু সন্তান রয়েছে- ১. স্কেলার বম (৬)(শিশু শ্রেণি, রুমা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)। ২. স্কেন্দি বম (৩)। কিন্তু বর্তমানে তার স্ত্রী ও সন্তানাদি সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
তবে উপরোক্ত স্থানে তিনি প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করে পাঁচ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বিলাসবহুল ভবন তৈরি করছেন । জঙ্গি কাজে লিপ্ত হয়ে ও সন্তু লারমার অর্থ সহযোগিতা নাথান বমকে উচ্চবিলাসী করে এবং বেপরোয়া জীবন থেকে সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি ও বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ধাবিত করে। সূত্রের তথ্য মতে জানা যায়, বৈদেশিক দাতাসংস্থা, মিশনারী ও এনজিও এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নাথান বম বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ গঠন করতে সক্ষম হয়। সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে ও চাঁদা আদায় করে চাঁদার টাকা দিয়ে মিজোরামে সে একটি বাড়ি তৈরি করেছে বলে বাস্তব প্রমাণ মেলে।
নাথান বম এর কর্মজীবন ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছিল সবসময় উশৃংখল স্বভাবের। স্কুল জীবন থেকে পিসিপি রাজনীতির প্রতি দূর্বল ছিলেন।
ঢাকা কলেজে অধ্যায়ন কালে ঢাকা মহানগর পিসিপি শাখার সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন কালে কেন্দ্রীয় পিসিপির অন্যতম সক্রিয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা যায়।
তিনি সন্তুলারমার খুবই আস্থাভাজন ছিলেন। সন্তু লারমার নির্দেশে জেএসএস ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠন পিসিপি সংগঠন থেকে তার পড়াশোনার খরচের যোগান দেওয়া হতো বলে জানা যায়। এসময় তিনি সন্তু লারমার আদর্শে দিনে দিনে বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মনোভাব পোষণ করে গড়ে উঠে৷ তার মধ্যে লালন ও সৃষ্টি হয় বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীর প্রতি হিংসা ও বিরূপ ধারণা ও ঘৃণার মনোভাব।
তিনি চারুকলা বিষয়ে ডিগ্রীধারী হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গী স্কোয়ারের পাশে নির্মিত তথাকথিত জুম্ম জাতির পিতা এম এন লারমার ভাস্কার্যটি (মুরাল) তৈরির অন্যতম কারিগর ছিলেন। একাজের জন্য তিনি পিসিজেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা তাকে ভূয়সি প্রশংসা করেন বলে জানা যায় এবং তাকে এ পর্যায়ে আসতে ভূমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন একাজের পারিশ্রমিক ও সম্মান হিসেবে সন্তু লারমা নাথান বমকে কোটি টাকা পুরষ্কৃত করেন। যার কারণে নাথান বম এর পৃষ্ঠপোষক বলা হয় সন্তু লারমাকে।
.কেএনডি গঠন-
জানা যায়, আনুমানিক ২০০৮ সালে তিনি নিজস্ব বম জাতিসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বার উন্নয়ন কল্পে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি পেশ করেন। এ প্রেক্ষাপটে তিনি নিজেকে সভাপতি করে রুমা উপজেলা সদরে কেএনডি ও কুকি- চিন ন্যাশনাল ডেভলোপমেন্ট অরগানাইজেশন) নামে সমাজ কল্যানণমুলক একটি সেন্ট্রাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।পরবর্তীতে,গত ২৮ জুন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে রুমা উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন নামে রেজিসট্রেশন করা হয়, যার নিবন্ধন ২৬৬/২০১৫ বলে জানা যায়।
কেএনএফ গঠন-
উক্ত সংগঠনটির খোলসের আঁড়ালে ২০১৭ সালে নাথান বম নিজকে সভাপতি করে ধীরে ধীরে কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র দল/ সংগঠন গঠন করেন। এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী অঞ্চল সমূহে (অন্ততঃ ১১ টি উপজেলা) নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র/ জৌ- ল্যান্ড গঠন করা।
জাতীয় সংষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ-
নাথান বম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বার (অন্ততঃ ৬ টি উপজাতি) প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৮ সালে বান্দরবান সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বান্দরবান জেলা নির্বাচন অফিসে মনোনয়ন ফরম জমা দেন। কিন্তু জমাকৃত ডকুমেন্টস ত্রুটি পূর্ণ হওয়ায় তাঁর মনোনয়ন পত্র নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাতিল ঘোষণা করা হয় বলে জানা যায়।
বর্তমান অবস্থান-
স্থানীয় সুত্রে নাথান বম এর সঠিক অবস্থান জানা যায়নি। তিনি প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করেন। তিনি প্রায়ই লন্ডনসহ ইউরোপিয়ান অনেক দেশ ভ্রমনে যান। তিনি একাধিক বার রুমা / বিলাইছড়ি সীমান্তবর্তী কেএনএফ এর গোপন আস্তানায় অবস্থান করেছেন বলেও জানা যায়। বর্তমানে তার অবস্থান ভারতের মিজোরামে বলে জানা যায়।
তিনি সুদানে দ্বৈত - নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। জু্ম লেখক হিসেবে পরিচিতি ছিল।তিনি নিজেকে জৌ -জাতির লেখক/ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিতে বেশী পছন্দ করেন। জৌ -জাতিকে নিয়ে একাধিক বইও রচনা করেছেন।তাঁর লেখা বমজৌ নামের বইটি অন্যতম প্রসিদ্ধ বই বলে জানা যায়।
নাথান বম বর্তমান সময়ের কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সংক্ষেপে কেএনএফ সবচেয়ে আলোচিত একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী নেতা। সেই ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন এর দলছুট সদস্য ও নেতাকর্মীদের দিয়ে কেএনএফ গঠন করে।
কেএনএফ সম্পর্কে জানা যায়- ফেসবুকে তারা একটি পেইজ খুলেন। সে পেইজ থেকে তারা দাবি করছেন রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। জাতিগুলো হলো- বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। তারা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম-এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা একাধিক বিবৃতিতে এই সংগঠন জানায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেছে তারা। তাদের মূল সংগঠনের সভাপতি নাথান বম। তাদের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় কুকি চিন রাজ্য ছিলো৷ চাকমরা তাদের সে রাজ্য দখল করে তাদের উচ্ছেদ করেছে। সে রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং স্বাধীন কুকি চিন রাজ্যের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে বান্দরবান জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা ও রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি। তাদের আরো দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। চলতি বছর তারা আত্মগোপনে যায়। যদিও তারা বলে আসছেন তারা ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সূত্র ও তাদের কার্যক্রম বিবেচনায় তাদের এই দাবির পক্ষে সত্যতা নেই। কারণ তৎকালীন তাদের সশস্ত্র শাখার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র ভিডিও প্রচার এবং কুকি-চিন রাজ্য গঠন করার দাবির পর সেনাবাহিনী তথা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে তারা। এর পর তাদের বিরুদ্ধে একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ার অভিযোগ উঠে। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশনে নামে। অপারেশনে ৩ কেএনএফ সশস্ত্র সদস্য ও ৭ জঙ্গীসহ সর্বমোট ১০ জনকে আটক করতে সক্ষম হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় তাদের কাছ তাদের থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। অপারেশনের একপর্যায়ে কেএনএফ কোণঠাসা হয়ে যায়৷ বলা যায় তারা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যায়। পালিয়ে যায় সংগঠনের সভাপতি নাথান বম।
আজকে এই নাথান বম সৃষ্টির পেছনে ছিলো জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা এবং বৈদেশিক কতিপয় দাতাসংস্থা, এনজিও, মিশনারীগুলো। তাদের মদদপুষ্টে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কেএনএফ গঠন হয়। মায়ানমার ও ভারতের মিজোরাম এর বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের দলছুট সশস্ত্র সদস্য ও নেতাকর্মীদের দিয়ে গঠন হয়। এরপর বান্দরবান জেলার গহীন অরণ্যকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়। সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অবশেষে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি কোণঠাসা হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সংগঠনের সভাপতি নাথান বম পালিয়ে পায়।
ভবিষ্যতে কেউ যদি কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর মতো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দুঃসাহস প্রদর্শন করে তাদেরও বিষদাঁত উপড়ে ফেলবে সকল নিরাপত্তা বাহিনী। তাই সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ পরিহার করে শান্তি-সম্প্রীতির পাহাড় গঠনে এগিয়ে আসা হবে উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন