সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনও বদলেছে। সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে বহু গুণে, বেড়েছে সব কিছুর চাহিদাও। মানুষ তার সব প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। পরিবেশের মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হলো মোট বনভূমি। বর্তমান সময়ে বনভূমি উজাড়ের ফলে পরিবেশ ও জনজীবনে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
বৃক্ষ মানবজাতির ঢালরূপে কাজ করে। খাদ্যের উৎস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যর ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকার ফল, মিষ্টি রস, ভেষজ দ্রব্য, কাঠসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ পাই। সমগ্র বিশ্বে বৃক্ষভিত্তিক বৃহৎ শিল্প, যেমন- কাগজ, রাবার, রেয়ন, হার্ডবোর্ড, রেশম, চা, পামঅয়েল, কোকো ইত্যাদি এবং কুটির শিল্প, যেমন- আগর, রেজিন, লাক্ষ¥া, খয়ের, মধু, বাঁশ-বেত শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে। উন্নত দেশগুলোতে ২৫ শতাংশ ওষুধের কাঁচামাল উদ্ভিদ থেকে আসে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই অবদান ৮০ শতাংশের বেশি। বৃক্ষরাজি বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ এবং অক্সিজেন ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় ১০০ গ্যালন পানি নির্গত করে পরিবেশ ঠান্ডা রাখে। কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন আর্দ্রতা কমে যায়, যার ফলে অন্যান্য সব গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। এছাড়াও গোটা পৃথিবীকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করে থাকে বনভূমি।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কোনো দেশের ২৫% ভূমিতে বনভূমি থাকা দরকার। বর্তমানে দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারিভাবে ১৭% উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে বাস্তবে রয়েছে ৮-১০%। দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। প্রতি বছর দেশে ১.২২% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতি স্থাপন এবং শিল্পায়নের ফলে ১% হারে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস ও ৩.৩% হারে বন নিধন হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর যে পরিমাণ বন উজাড় হচ্ছে, তার তুলনায় বাংলাদেশে বেশি হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হয়। উজাড় হওয়া থেকে সংরক্ষিত বনও রক্ষা পাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে পরিচিত দেশের সংরক্ষিত বন ‘সুন্দরবনের’ বিস্তার ও ঘনত্ব উভয়ই কমছে। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে (২০০০-২০) সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মারাত্মক হারে কমেছে। কমেছে বনের ঘনত্বও। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা বা পতিত জমির পরিমাণ বেড়েছে। সুন্দরবনের বিস্তার আগের তুলনায় কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সংরক্ষিত বনের যদি এ দশা হয়, তাহলে অরক্ষিত বনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
বনভূমি উজাড়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধভাবে বনভূমি দখল। দেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর, এই বনভূমির একটি বড় অংশ প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদখল করে রেখেছে। জমি দখল করে ঘররাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা। বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দখলদারদের মধ্যে ৮৮ হাজার ২১৫ জন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটা বা অন্য কোনো উপায়ে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না বলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কেটে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছেই।
অন্যদিকে বনভূমি উজাড়ের আরেকটি কারণ জনসংখ্যার বৃদ্ধি। দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; যার ফলে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। মানুষ তার বাসস্থানের জন্য গাছ কেটে বসতির ব্যবস্থা করছে। তাছাড়া বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন বাড়তি খাদ্যের, যা সীমিত সম্পদের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। মানুষ তার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে বনভূমি উজাড় করে কৃষিজমি তৈরি করে নিজেদের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। দেশে কাঠের চোরাচালান ব্যবসা আছে। এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারের বিধিনিষেধ অমান্য করে বেআইনিভাবে গাছ কেটে বনভূমিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নতুন রাস্তা ও রেলপথ তৈরির জন্য যে জায়গার প্রয়োজন হয় তার জন্য গাছপালা ও বনভূমি কাটা হচ্ছে, যার ফলে বনভূমি উজাড় হওয়ার পাশাপাশি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। বনভূমি অঞ্চল হতে প্রাপ্ত নতুন খনিজসম্পদ উত্তোলনের জন্য উত্তোলন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়, যার ফলে বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। যেমন দাবানল, ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, অ্যাসিড বৃষ্টি, ভূমিধস, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি।
দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও কৃষি সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বনভূমি কমছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাচ্ছে, যার ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় নিম্ন এলাকা তলিয়া যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্ন এলাকা সাগরের লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সব থেকে বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি-পানি ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে নতুন নতুন অণুজীব অবমুক্ত হচ্ছে। যার ফলে সংক্রামক রোগব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে।
সুস্থ জীবনধারণের জন্য বনের জীবন বাঁচানো অত্যাবশ্যকীয়। মানুষ প্রকৃতি ধ্বংসে দায়ী। তেমনি মানুষের দ্বারাই প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেতে পারে। মানুষ ও প্রকৃতির আন্তসম্পর্কের মাধ্যমে পরস্পর সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার মাধ্যমে বনভূমি পুনরুদ্ধারের নতুন রেনেসাঁস জরুরি। মোটা দাগে এভাবে চিন্তা শুরু করা যেতে পারে। প্রতিটি গাছ পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি গাছকে বাঁচাতেও উন্নয়ন নকশায় পরিবর্তনের নজির আছে। ক্ষুদ্র পরিসরে বৃক্ষরোপণ এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পও পরিবেশে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা, বায়ু দূষণ হ্রাস, পরিবেশ শীতলকরণ এবং বন থেকে অন্যান্য পরিষেবার গুণগত পরিমাণ বাড়াতে বনের জীবন বাঁচানো জরুরি।
বন সংরক্ষণের মাধ্যমেই শোভন ও পরিবেশবান্ধব জীবিকার ব্যবস্থা হতে পারে। বন থেকে বিশ্বব্যাপী ৮৬ কোটির বেশি কাজের ব্যবস্থা হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা গেলে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে দরকার স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়ন। বনবাসী এবং বনজীবীদের অংশগ্রহণে সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তাহলে স্থানীয় জনগণই বন ও বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসবে। সড়কপথ, রেলপথের দু-ধার, পাহাড়, টিলা, উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা, নদ-নদী, খাল-বিলের পাড়, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, হাটবাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপন করতে হবে। অবাধে পাহাড় কাটা, নদী ভরাট এবং বালু উত্তোলন রোধ ও আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ এবং বৃক্ষ কর্তনের ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বিচারে বন্য ও জলজ প্রাণী শিকার বন্ধ করতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পদকে সংরক্ষণের জন্য অভয়ারণ্য, উদ্ভিদ উদ্যান, অভয়াশ্রম, শিকার সংরক্ষিত এলাকা ইত্যাদি সৃষ্টি এবং বন-জঙ্গল, জলাশয়, নদী, সাগর দূষণমুক্ত রাখতে হবে। কাঠের ফার্নিচারের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি ফার্নিচার ব্যবহার করতে হবে। খড়ির বিকল্প হিসেবে চারকোল, গ্যাস, কয়লা ও ঘুটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আইইউসিএনের টাঙ্গুয়ার হাওর, কক্সবাজার, নিঝুম দ্বীপসহ কয়েকটি প্রকল্পের শিক্ষণের আলোকে আরও সহব্যবস্থাপনা প্রকল্প নিতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশের বাস্তুসংস্থানে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। মূলত নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই বন ও বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা অতীব জরুরি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোই বেশি দায়ী। তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ দেশগুলোর ওপর গ্রিনট্যাক্স, কার্বনট্যাক্স কার্যকর করে একটি অর্থ তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবেশ উন্নয়নে ওই অর্থ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে অন্তত একটি বৃক্ষ চারা রোপণ ও পরিচর্যা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্পায়ন বিশ্বকে করেছে অনেক উন্নত ও আধুনিক। তাই শিল্পায়নের অগ্রগতি বজায় রেখেই বিশ্ববাসীকে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে উদ্বুদ্ধ এবং পরিবেশবাদী সংগঠন ও মিডিয়াগুলোকে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন