শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসনে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

অনেক আশঙ্কা, আতঙ্ক ও উদ্বেগের পর অবশেষে আমরা ঘূর্ণীঝড় সিত্রাংয়ের আঘাত পেরিয়ে এসেছি। সিত্রাংয়ের শক্তি, আঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক, এটি আমাদের আবহাওয়া পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নতুন বিবেচনা ও মূল্যায়ণে বাধ্য করবে। সিত্রাং নিয়ে পূর্বাভাস ও আশঙ্কার সাথে বাস্তবের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘুর্ণীঝড়টি প্রবল সুপার সাইক্লোনের শক্তিতে আঘাত করার হিসাব এবং এর গতিপথ কোনোটির ক্ষেত্রেই আমাদের আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস সঠিক হয়নি। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সুত্রগুলো বঙ্গোপসাগরে একটি প্রবল মাত্রার ঘূর্ণীঝড় সৃষ্টির লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে অক্টোবরের ১৮ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনসহ উপকুলীয় অঞ্চলে আঘাত হানার পূর্বাভাস দিয়েছিল। দেড় দশক আগে ২০০৭ সালের ঘূর্ণীঝড় সিডরের চেয়েও সিত্রাংয়ের শক্তি ও ধ্বংসক্ষমতা বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও আদতে তা ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী। তবে এই নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল ঘূর্ণীবায়ু ও ভারী বৃষ্টিপাতজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও নেহায়েত কম নয়। দেশ যখন সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে একটি ক্রান্তিকালে রয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক আশঙ্কার মধ্যে এই ঘূর্ণীঝড়ের ক্ষতি যেন বোঝার উপর শাকের আঁটির মত দুর্বহ হয়ে উঠেছে।

সিত্রাংয়ের আঘাতে যে ক্ষতির চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা যদি পূর্বাভাস অনুসারে সিডর বা আইলার শক্তিতে আঘাত হানত, তাতে দেশের উপর কী বিপর্যয় নিয়ে আসত সেটা ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়। গতকাল সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে ঘুর্ণীঝড় সিত্রাংয়ে অন্তত ৩৫জনের প্রাণহানি এবং কয়েকশ মানুষ আহত হওয়ার খবর জানা যায়। ঝড়ের তান্ডবে উপকুলীয় অন্তত ১০টি জেলার কোটি মানুষ বিদ্যুতহীন এবং ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার হেক্টর জমির উঠতি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনিতেই জ্বালানি, বিদ্যুত ও সারের সঙ্কটের কারণে আগামি মওসুমে খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেখানে ঘুর্ণীঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি, হাজার হাজার মানুষের কাচা বাড়িঘর ধসে যাওয়া এবং উপকুলীয় বেড়িবাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রভাব অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক বড় আঘাত হিসাবে পরিগণিত হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ঘুর্ণীঝড়ের আঘাতে শত শত মানুষ হতাহত হওয়া এবং সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির পেছনে আবহাওয়া অফিসের ভুল মেসেজের দায় রয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের বিশেষ বুলেটিনে মঙ্গলবার সকাল ৬টা নাগাদ সিত্রাং বাংলাদেশের উপকুলে আঘাত হানার কথা বলা হলেও এটি সোমবার রাত ৯টায় বাংলাদেশ উপকুলে আঘাত হানে। সাগরের উপকুলে অবস্থানরত একটি ট্রপিক্যাল ঘূর্ণীঝড় সম্পর্কে আমাদের আবহাওয়া অফিস সঠিক পূর্বাভাস দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

সিত্রাংয়ের আঘাত দেশের জন্য আরো বড় ধরণের সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারতো। ঘূর্ণীঝড়ের সম্ভাব্য আঘাত মোকাবেলা, ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকান্ড পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তদারকি ও নির্দেশনা দিয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুর্যোগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর এমন ঐকান্তিক প্রয়াসকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে আবহাওয়া অফিসের টেকনিক্যাল ও প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয় নয়। এটি একান্তই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও মেটিওলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ, যোগাযোগ ও দক্ষতার বিষয়। সেখানে আমাদের আবহাওয়া অফিসের ব্যর্থতা বিষ্ময়কর। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ও উন্নত আকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো প্রাকৃতিক অবস্থার সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হলেও এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়া অফিস যে পূর্বাভাস দিয়েছে তা অনুমান নির্ভর ও মিথ্যা বলে প্রমানিত হয়েছে। সঠিক পূর্বাভাস দেয়া হলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ আগেই আশ্রয় কেন্দ্রে আসত এবং ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি আরো কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। এই ব্যর্থতার কারণে দেশের আবহাওয়া অফিসের দুযোর্গ সতর্ককীকরণ ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে পড়তে পারে। এ ধরণের অনাস্থা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরণের প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিতে পারে। ঘূর্ণীঝড় সিত্রাংয়ের পূর্বাভাসে আমাদের আবহাওয়া অফিসের ভুল মেসেজ আমাদের জন্য অনেক বড় শিক্ষা। আবহাওয়া অফিসকে অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আঞ্চলিক সব আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর সাথে নিবিড় যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয় রক্ষা করতে হবে। সিত্রাংয়ে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে সরকারি সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আগামি ফসলের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুত লাইন ও বেড়িবাঁধগুলো দ্রুততম সময়ে মেরামত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সমন্বিত কার্যব্যবস্থা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসনে যথাযথ উদ্যোগ নিবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন