ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং দুর্বল হয়ে দক্ষিণ উপকূল অতিক্রম করার পরে ক্ষয়ক্ষতি ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গত সোম ও মঙ্গলবারের এ ঝড়ের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আরো একটি ঝড় প্রতিহত করতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে উপকূলীয় বনভূমি। দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার মাঠে থাকা প্রায় ৭ লাখ ১০ হাজার হেক্টর ফসলের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার ঝড়ের কবলে ক্ষতির কবলে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এরমধ্যে প্লাবনের শিকার শুধু আমন ধানের পরিমাণই ১২ হাজার হেক্টর বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএই সূত্রে জানা গেছে। তবে বাস্তবে প্লাবিত জমির পরিমাণ লক্ষাধিক হেক্টরেরও বেশি বলে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। আমন ছাড়াও মাঠে থাকা বিভিন্ন ধরনের সবজি, পান, কলা ও পেঁপে বাগানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে ডিএই ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগহের পাশাপাশি পানি সরে যাওয়ার পড়ে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপন করবে বলে জানা গেছে। ফলে এ মুহূর্তে ঠিক কত টাকার ফসলহানী বা ক্ষতি হয়েছে তা জানায়নি ডিএই।
অপরদিকে সিত্রাং-এ ভর করে প্রবল বর্ষণসহ স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট উচ্চতার জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের প্রাথমিক প্রতিবেদনে টাকার অংকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৭ কোটি টাকা বলে জানান হয়েছে। সিত্রাং-এর প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার হেক্টরের ১২ হাজারেরও বেশি পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৮ টন মাছ, ৭১ লাখ পোনা ভেসে যাওয়া ছাড়াও ৫৫টি মাছধরা নৌকা ও ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মৎস্য সেক্টরে প্রায় ২.২৭ কোটি টাকা মূল্যের অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে মাছ আর পোনা ভেসে যাওয়ায় এ অঞ্চলের অনেক মৎস্যজীবী সর্বশান্ত হয়ে গেছে। মৎস্য সেক্টরে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতেই সর্বাধিক পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
অপরদিকে প্রাণি সম্পদ সেক্টর থেকেও যথেষ্ঠ দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। সিত্রাং-এর তাণ্ডবে দক্ষিণাঞ্চলের ৪২ উপজেলার ২০৯টি ইউনিয়নে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির খামারের যথেষ্ঠ ক্ষতি হয়েছে। প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের দপ্তরের মতে প্রায় ৩৪ হাজার গরু, ১০ হাজার মহিষ, ২৮ হাজার ছাগল, ২ হাজার ছাগল ছাড়াও প্রায় আড়াই লাখ মুরগী এবং ৯০ হাজার হাঁস দুর্যোগের শিকার হয়েছে।
তবে বিপন্ন এসব প্রাণিকূলের মধ্যে ঝালকাঠী জেলার কোন তথ্য নেই। ঝড়ের বিপর্যয়ের কবলে পরা এসব প্রাণির মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ১৭ হাজার মুরগী ও আড়াই হাজার হাঁস ছাড়াও আড়াইশরও বেশি মহিষ, ৪২টি গরু, ১৩০টি ছাগল, ৮০টি ভেড়ার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১০ হাজার হেক্টর চারনভূমি প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতির পরিমান ভোলাতেই সর্বাধিক।
সিত্রাং-এর ভর করে আসা ঝড় জলোচ্ছাসে দক্ষিণাঞ্চলে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেক বেশী বলে জানিয়েছেন হাঁস-মুরগী ও গবাদিপশুর খামারিগণ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাঠ কর্মীগণ ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চল যড়ে অসুস্থ প্রানিকুলের চিকিৎসা কার্যক্রম ছাড়াও ব্যাপকভাবে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরুর কথা জানিয়েছেন বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. আবদুস সবুর।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং দুর্বল হয়ে ভোলা-হাতিয়া ও সন্দীপ উপকূলে আঘাত হানলেও তাকে প্রথমেই প্রতিহত করতে গিয়ে উপকূলীয় বনাঞ্চলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে বন বিভাগের উপকূলীয় বন অঞ্চল থেকে এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোন তথ্য দিতে না পাড়লেও মাঠ পর্যায়ে ক্ষতি পর্যবেক্ষণে তাদের টিম কাজ করছে বলে বন সংরক্ষক মো. হারুন জানিয়েছেন।
দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর বনভূমি সৃজন করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় প্রতিহত করতে গিয়ে সুন্দরবন সহ উপকূলীয় লবনাম্বুজ বনভূমি বার বারই ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। তবে এসব বনভূমি সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করতে ‘প্রকৃতির ঢাল’ বা ‘রক্ষা কবজ’ হিসেবেই কাজ করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন